Advertisement
E-Paper

কৃষিঋণ মুকুবের প্রাসঙ্গিকতা ও কয়েকটি অপ্রিয় সত্য

কৃষিঋণ মুকুবের সামগ্রিক সামাজিক প্রেক্ষাপটটি খুবই জটিল। গত কয়েক বছর ধরেই কৃষিক্ষেত্রে উপাদান ব্যয় বাড়ছে। সার, সেচে, বীজের খরচ বহুগুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় ফসলের দাম খোলাবাজারে খুব একটা বাড়েনি। লিখছেন ভাস্কর গোস্বামীপ্রায় প্রত্যেক নির্বাচনের আগে জনপ্রিয় কিছু প্রতিশ্রুতির ঘোষণা করে সব রাজনৈতিক দলই। এর মধ্যে কৃষিঋণ মুকুবও পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলির ধারণা, এই প্রস্তাব খুব সহজেই কৃষক ও তাঁদের পরিবারের মন জয় করতে পারে।

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৩০

প্রায় প্রত্যেক নির্বাচনের আগে জনপ্রিয় কিছু প্রতিশ্রুতির ঘোষণা করে সব রাজনৈতিক দলই। এর মধ্যে কৃষিঋণ মুকুবও পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলির ধারণা, এই প্রস্তাব খুব সহজেই কৃষক ও তাঁদের পরিবারের মন জয় করতে পারে। ধারণাটি ভুল নয়। সম্প্রতি, পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল দেখলে তা বোঝা যায়। নোটবাতিল, তড়িঘড়ি জিএসটি-র রূপায়ণ, কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনায় ব্যর্থতা এবং প্রায় সব স্বাধীন কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির ওপর ‘অনৈতিক’ হস্তক্ষেপের মতো বিষয় থাকলেও ফলাফলে চাষিদের অসন্তোষ প্রবল প্রভাব ফেলেছে। দেশের নানা প্রান্তে চাষিদের অসন্তোষ খেতের গণ্ডী ছাড়িয়ে রাজপথে বিশাল মিছিল হয়ে নেমে এসেছে। তাই ক্ষমতায় এসেই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এ ছত্তীসগঢ়ে কৃষিঋণ মুকুবের কথা ঘোষণা করে কংগ্রেস। একের পরে এক, অন্য রাজ্যগুলিও একই নীতি গ্রহণ করে চলেছে। কৃষিঋণ মকুব তাই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

এই আলোচনার দু’টি প্রেক্ষিত আছে। একটি, আর্থ-সামাজিক। অন্যটি, পুরোপুরি অর্থনৈতিক। প্রথমে আলোচনা করা যাক কৃষিঋণ মুকুবের আর্থ–সামাজিক প্রেক্ষিতটি নিয়ে।

কৃষিঋণ মুকুবের সামগ্রিক সামাজিক প্রেক্ষাপটটি খুবই জটিল। প্রথমেই জানতে হবে, কৃষক কেন ঋণ নেন? এর একটি সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে, কৃষক তাঁর উৎপাদিত ফসলের যে দাম পান, তা চাষের উৎপাদনের ব্যয় থেকে কম। কয়েক বছর ধরেই কৃষিক্ষেত্রে উপাদান ব্যয় বাড়ছে। সার, সেচে, বীজ— প্রায় সব ক’টি উপাদানেরই খরচ বহুগুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় ফসলের দাম খোলাবাজারে খুব একটা বাড়েনি। সরকারের যে ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’ (মিনিমাম সার্পোট প্রাইস) ঘোষণা করে তা এই ব্যয়ের থেকে খুব একটা বেশি নয়। এ ক্ষেত্রে স্বামীনাথন কমিটির পেশা করা রিপোর্টে যে ভাবে নূন্যতম সহায়ক মূল্য স্থির করার কথা বলা হয়েছে তা এখনও মানা হয়নি। যা মানলে এক ধাক্কায় নূন্যতম সহায়ক মূল্য অনেকখানি বেড়ে যেত। ফলে ফসলের দাম ও ফসল উৎপাদনের খরচের মধ্যে অসামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। তাই, উৎপাদিত ফসলের দাম ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য আনার জন্য কৃষক ঋণ নেন। এটি বিশেষ করে প্রান্তিক চাষি ও ভাগচাষিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হয়। চাষি বিপদে পড়েন। এর থেকে বাঁচাতে পারে ফসলবিমা। কিন্তু, এখনও এ দেশে বহু চাষি ফসলের বিমা করেন না। বিমা করতে গেলেও নানা বাধার সামনে পড়তে হয় তাঁদের। যেমন, চাষির কাছে নানা তথ্য দাবি করা হয়। সেই দাবি মেটানো অনেক চাষিরই পক্ষেই সম্ভব হয় না। পাশাপাশি, ফসল বিমার প্রিমিয়ামও উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। ফলে চাষি আবার কৃষিঋণ নিতে বাধ্য হন।

কিন্তু, কৃষিঋণ অনাদায়ী থাকে কেন? কিসান ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে চাষি এক একর জমির ধান চাষের জন্য এককালীন ৩৩ হাজার টাকা পান। এই ঋণের সুদ চার শতাংশ হয়, যদি তা এক বছরের মধ্যে ঋণ শোধ দেয়া হয়। তা না হলে সুদের পরিমাণ বাজারচলতি সুদের সমান, অর্থাৎ নয় শতাংশ হয়। উৎপাদনের খরচের থেকে কম হারে উৎপাদিত ফসলের দাম বাড়ায় চাষির পক্ষে এক বছরের মধ্যে কৃষিঋণ শোধ করা সম্ভব হয় না। চাষি বাধ্য হয়ে কৃষিঋণের বোঝা টেনে যান। অনেক সময়ে সেই বোঝা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে চাষি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। দেশের নানা প্রান্তেই এমন ঘটেছে। এই দুর্বিষহ যন্ত্রণার থেকে মুক্তির জন্য কৃষিঋণ মুকুবের প্রস্তাব সামাজিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিন্দুকেরা এই কৃষিঋণ মুকুবের প্রবল বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু, ‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া’ (আরবিআই) পরিসংখ্যানে দেখাচ্ছে মোট অনাদায়ী ঋণের প্রায় ২১ শতাংশের জন্য দায়ী বড় শিল্পপতি ও শিল্পগোষ্ঠীরা। আর কৃষিক্ষেত্রে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ মোট অনাদায়ী ঋণের প্রায় ৬ শতাংশ।

কিন্তু একই সঙ্গে বলতে হবে যে কৃষিঋণ মুকুবের নীতি একটি তাৎক্ষণিক সমাধান মাত্র। অর্থনীতির দৃষ্টিতে কৃষিঋণ মুকুব কখনই স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। আর এখানেই চলে আসে আলোচনার দ্বিতীয় প্রেক্ষিতটি।

অনাদায়ী ঋণের জন্য ব্যাঙ্কগুলির ‘নন পারফর্মিং অ্যাসেটস’-এর বোঝা বাড়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলির ব্যালেন্স শিটে এর প্রভাব পড়ে। শুধু তাই নয়, কৃষিঋণ মুকুবের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলি পরে চাষিদের ঋণ দিতে খুব একটা আগ্রহী হয় না। আখেরে চাষিদেরই অসুবিধা হয়। তাই দরকার স্থায়ী সমাধান। কিন্তু, কী সেই সমাধান?

বিগত দশকগুলিতে কৃষিক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সরকারি ‘পরিকল্পনা বহির্ভূত ব্যয়’ (আনপ্ল্যানড এক্সপেন্ডিচার)। তা সে, ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ তৈরির জন্যই হোক বা সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য। কৃষিক্ষেত্রে সমস্যার স্থায়ী সমাধান লুকিয়ে আছে নূন্যতম সহায়ক মূল্যের মধ্যে। কৃষিক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য প্রায় সব সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকুরেদের আয় গত বছরগুলিতে বহুগুণ বেড়েছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে সরকারি চাকুরেদের আয়। কিন্তু সেই তুলনায় কৃষকের আয় প্রায় বাড়েনি, উল্টে দিনের পরে দিন কমেছে। সমাজে অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সপ্তম বেতন কমিশনে সরকারি চাকুরেদের আয় হিসেব হয়েছে ‘কস্ট অব লিভিং ইন্ডেক্স’-এর উপরে ভিত্তি করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নূন্যতম সহায়ক মূল্য কখনই কৃষকদের ‘রুরাল কস্ট অব লিভিং ইন্ডেক্স’-উপরে ভিত্তি করে হয় না। যেন, কৃষকদের কোনও স্বাস্থ্যবিমার দরকার হয় না, দরকার হয় না কোনও শিক্ষাঋণের। একটি অযৌক্তিক প্রাচীন চিন্তা ভাবনা! ফলে চাষিরা বঞ্চিতই থেকে যান। আয়ের অসম বণ্টন ক্রমে বাড়তে থাকে। বাড়ে চাষিদের অসন্তোষ।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক

Loan Waivers Farmers
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy