Advertisement
E-Paper

কেন হাত পাততে হবে?

প্রকৃত তথ্য কী বলে, দেখে নেওয়া যাক। এটা ঠিকই যে পুজোর সময় (শুধু অনলাইনই) কেনাকাটার হার বৃদ্ধি পায় ৫৬%, কিন্তু তার মধ্যে পুরুষদের কেনাকাটার অংশ মহিলাদের থেকে প্রায় তিনগুণ বেশি।

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০৫

চা র পাশে সাজ সাজ রব। নিজেদের সাজতে হবে, বাড়িঘর সাজাতে হবে। পুজো উপলক্ষে বিশেষ ডায়েট প্ল্যান, যাতে পুজোর ক’দিন বিশেষভাবে স্লিম বা রোগা দেখায় (রোগা শব্দের উৎস রুগ্‌ণ— এ কথা মনে না করানোই ভাল)। পুজো, পুজোর জামাকাপড়, পুজোর জন্য ডায়েটে ইদানীং পুংলিঙ্গের অধিকার জন্মালেও এখনও তা নারীশাসিত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনের ফ্যাশন থেকে রান্না, সবেতেই পুজোয় কী পরবেন, সেই সব জামাকাপড়ে ফিট করার জন্য কী খাবেন না, বাড়ির লোকেদের, বরের বন্ধুদের কী রান্না করে চমকে দেবেন। চাহিদা সৃষ্টি থেকে সামাজিক আচরণ, সবই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে মিডিয়ার পুজো-স্পেশাল অভিযান। যদি পুজোর আগে রোগা না হতে পারি, তা হলে উৎকণ্ঠায় ভুগি। যদি বাড়িঘর যথেষ্ট পরিষ্কার করতে না পারি তা হলেও। যে সব শাড়িকে এই পুজোর মাস্ট বলে দিয়েছে সেগুলো না কিনতে পারলে, ঠিক ‘হেয়ারডু’ না করাতে পারলেও। পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশনে যে কাঠামো ঠিক করে দিয়েছে তাতে ‘ফিট্‌’ না করলেও। এই উৎকণ্ঠা সারা বছরই থাকে, তবে বেড়ে যায় পুজোর সময়। যেন উৎসব উপলক্ষে সবার সামনে সারা বছরের প্রস্তুতির বার্ষিক পরীক্ষা এসে উপস্থিত হয়েছে। এই কাঠামো বা আদর্শ মডেলের লক্ষ্য মূলত আমরা মেয়েরা, কারণ সোনার আংটি আজও ব্যাঁকা হয় না। পুরুষমানুষের টি-শার্টে মধ্যপ্রদেশ দৃষ্টিকটু ভাবে হলে লোকে খুব বেশি হলে দু’একটা সরস মন্তব্য করবে। সমবয়সি মহিলা মোটা হলে তাকে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেওয়া হবে তার যৌবন অস্তমিত, আর তার সে আকর্ষণ নেই। কুসুমের মন আছে কি না, সে প্রশ্ন নিরর্থক।

বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায় প্রায় তিন মাস আগে থেকে। সব থেকে কম দামে সব থেকে ভাল পোশাক কেনার প্রস্তুতি। মাটিতে বা ইথারে লোভনীয় সব ছাড়ের কথা হয়েই চলে। সারা দিন, কখনও বা মাঝরাতে,
প্রস্তুতি ব্যাগে জিনিস ভরতে থাকি আমরা। শুধু নিজের জন্য হাল ফ্যাশানের জিনিস কেনাই তো নয়, দেয় জিনিসপত্রের লিস্টেও কতটা দক্ষতা দেখাতে পারছেন গৃহিণী, তিনি যথেষ্ট ‘আপ টু ডেট’ কি না, স্বামীর অর্থের যথেষ্ট সাশ্রয় হল কি না, সেটাও বিচার্য।

আর এখানেই আসছে এই খেলার করুণতম অংশ। ঘেমেনেয়ে, ভীষণ বুদ্ধি খাটিয়ে সবার জিনিসপত্র কেনার পর অভিযোগ আসে অপচয়ের। টিভি শোতে প্রকাশ্যে তা-ই নিয়ে হাসাহাসি হয়।

প্রকৃত তথ্য কী বলে, দেখে নেওয়া যাক। এটা ঠিকই যে পুজোর সময় (শুধু অনলাইনই) কেনাকাটার হার বৃদ্ধি পায় ৫৬%, কিন্তু তার মধ্যে পুরুষদের কেনাকাটার অংশ মহিলাদের থেকে প্রায় তিনগুণ বেশি। এ তথ্যও সামনে আসে যে মহিলাদের ৭৬%ই সিওডি, মানে ক্যাশ অন ডেলিভারি-তে জিনিস কেনেন, অর্থাৎ জিনিসটা বাড়িতে এলে টাকা দেন। পুরুষরা কেনেন ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে (৮২%)। অর্থাৎ, বাড়ির মহিলা নানা উপায়ে সঞ্চিত অর্থ (যার জন্য তিনি উপহাসের পাত্রী) দিয়ে নিজের বা প্রিয়জনের জিনিস কেনেন। বাড়ির জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন যিনি, তাঁকে এইটুকু কেনার জন্য নানা উপায়ে অর্থ সঞ্চয় করতে হচ্ছেই বা কেন? এর উত্তর অনেক সময়ে পাওয়া যায় যে— কেন, ওকে তো আমি মাসে দু’হাজার টাকা হাতখরচা দিই, তার পর আবার দরকার পড়ছে কেন? অথবা, পুজোতে কেনাকাটার জন্য তো সবার টাকা ধরা হয়েছে, ও তো তাই দিয়ে জামদানি শাড়িও কিনেছে। তার পরে আবার চাইলে কী করে হবে?

গৃহিণীদের বার্ষিক আয় কত হওয়া উচিত, তার কতটা স্বামীর দেয়, কতটা সরকারের দায়িত্ব, সেই সব তর্কের মীমাংসা হয়নি। তবে সংখ্যার পরিমাপের থেকেও বিষয়টির মূল বক্তব্য এ বার বিবেচ্য হওয়া উচিত। আর নিজের জামদানি শাড়ি কেনার পর যদি প্রিয়জনের জন্য আর একটা কিছু কিনতে হয়, তখন আপনার কাছে হাত পাতা বা নানা উপায়ে জমানো টাকায় হাত দেওয়া ছাড়া উপায় আছে কী? অনেক নারীপ্রগতির কথা বলার পরেও এখনও কর্মরতা মহিলাদের অনুপাত মাত্র ১৩.৪%, যা গত কয়েক বছরে ৪৩% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের মধ্যে থেকেও মাত্র ২৩% মহিলা ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে কিনতে স্বচ্ছন্দ।

যদি ধরেও নিই, কোনও মহিলা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ‘শপিং’ করেন, তার জন্য কি ওই কাঠামোয় ‘ফিট’ করার প্রচণ্ড তাগিদ দায়ী নয়? যদি ধরেও নিই তাঁর কেনাকাটার পরিমাণ অস্বাভাবিকতার, এমনকী মনোরোগের পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার দায় সমাজ এড়াতে পারে কি?

সবশেষে বলি, কোনটা প্রয়োজন কতটা প্রয়োজন, কোনটা অপচয় কোনটা অপচয় নয়, তা এক বারের জন্য মেয়েদেরই ঠিক করতে দেওয়া হোক না! এই উপমহাদেশে পারিবারিক সিদ্ধান্তগ্রহণে মহিলাদের ভূমিকা নিতান্তই হতাশাপ্রদ।

রোজ দশভুজা হয়ে আপনার সংসারে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি, তাও আবার বিনামূল্যে, তাঁকে এই ক’দিন না হয় এইটুকু ছাড় দিলেন!

women family decisions Shopping
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy