Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

গন্ধেশ্বরী: একটি নদীর অপমৃত্যু

এক সময় গন্ধেশ্বরী নদী ছিল স্রোতস্বিনী। গন্ধেশ্বরী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে শিউলিবনা, ধবন, গোগড়া, আগয়া, কাঁটাবনি, চামকড়া, দুলালকুঁড়ি প্রভৃতি গ্রাম। এখন এই নদীর জল ব্যবহার করেই পেটের ও চর্ম রোগের শিকার হচ্ছেন মানুষ। লিখছেন সন্তোষ ভট্টাচার্যবাঁকুড়ার মানুষ গন্ধেশ্বরীকে ছোট নদী বলেই চেনেন। জেলার পশ্চিম সীমানায় শালতোড়া থানার কুলুরবাঁধ এলাকা এ নদীর উৎসস্থল।

গন্ধেশ্বরী নদী। ছবি: অভিজিৎ সিংহ

গন্ধেশ্বরী নদী। ছবি: অভিজিৎ সিংহ

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

বাঁকুড়া জেলায় ছোট-বড় বেশ কয়েকটি নদ-নদ রয়েছে। এগুলির মধ্যে জেলা শহর ঘেঁষে বয়ে যাওয়া গন্ধেশ্বরী ও দ্বারকেশ্বর অন্যতম।

বাঁকুড়ার মানুষ গন্ধেশ্বরীকে ছোট নদী বলেই চেনেন। জেলার পশ্চিম সীমানায় শালতোড়া থানার কুলুরবাঁধ এলাকা এ নদীর উৎসস্থল। মুরলু টিলার দক্ষিণ-পশ্চিম ঢালের জল গড়িয়ে এসে এই কুলুর বাঁধে সঞ্চিত হয়। এই কুলুর বাঁধের নীচের দিকে জলের স্রোত নেমে আসে ঝর্নার মতো। সৃষ্টি হয় ছোট নালার। পাশাপাশি, যুক্ত হয় আরও অনেকগুলি বৃষ্টির জলধারা। এই স্রোতধারা ক্রমাগত শালতোড়া থানার দক্ষিণ দিকে বয়ে এসে শুশুনিয়া পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিম হয়ে দক্ষিণ ঢালে বয়ে ছাতনা, বাঁকুড়া ১ ও বাঁকুড়া ২ ব্লক ছুঁয়ে ওন্দার ভূতেশ্বর গ্রামে দ্বারকেশ্বর নদে মিলিত হয়। এ জায়গাটিকে বলে দোমোহানির ঘাট।

৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীপথ। এক সময় এই গন্ধেশ্বরী নদী ছিল স্রোতস্বিনী। নদীকে ঘিরে বহু জায়গায় গড়ে উঠেছে প্রাচীন জনপদ ও নগরসভ্যতা। গন্ধেশ্বরীও সে রীতির ব্যতিক্রম নয়। গন্ধেশ্বরী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে শিউলিবনা, ধবন, গোগড়া, আগয়া, কাঁটাবনি, চামকড়া, দুলালকুঁড়ি প্রভৃতি গ্রামগুলি। উঁচুনিচু রুক্ষ খেত হয়েছে শস্যশ্যামলা। এই গন্ধেশ্বরীর ছোঁয়াতেই। এক দিকে, গন্ধেশ্বরী নদীর তীরে বাঁকুড়া শহরের পাঠকপাড়া, অন্য দিকে, দ্বারকেশ্বরের তীরে রাজগ্রাম হল বাঁকুড়া শহরের প্রাচীন জনপদগুলির অন্যতম।

শুশুনিয়া পাহাড়ের নিম্নাঞ্চলে এবং তার পাশে প্রবাহিত গন্ধেশ্বরী ও অপরাপর স্রোতস্বতী পথের দু’ধারে আবিষ্কৃত প্রত্ন নিদর্শন এবং জীবাশ্মগুলি ভারত তথা এশিয়ার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য বিষয়। ১৯৬৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিকার কর্তৃক শুশুনিয়া অঞ্চলে অনুসন্ধান কাজের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে এই ইতিহাস। পরেশচন্দ্র দাশগুপ্তের ‘প্রাগৈতিহাসিক শুশুনিয়া’ গ্রন্থটি এই অনুসন্ধান কাজ সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য দলিল।

আধুনিক নগর জীবনের বিকাশ এবং এক শ্রেণির চেতনাহীন মানুষের নির্দয় আঘাতে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রবাহিত গন্ধেশ্বরীকে মেরে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। শহরকে সুন্দর পরিচ্ছন্ন রূপে গড়ে তোলার দায়িত্ব যাঁদের হাতে, তাঁদের একাংশের চেতনা ও দক্ষতার অভাবের সাক্ষী বাঁকুড়া শহর। এক সময়ে বাঁকুড়া পুরসভা এই শহরের আবর্জনা ফেলা শুরু করে গন্ধেশ্বরী নদীর বুকে। পুরসভার নিকাশি নালাগুলির দূষিত জল সরাসরি গন্ধেশ্বরী নদীতে এসে মিশতে শুরু করে। শহরের গবাদি পশুর মৃতদেহ, বাজারের আবর্জনা, পচা মাছ, বাড়ি ভাঙা-সহ নদী তীরবর্তী হোটেল ও অন্য দোকানগুলির যাবতীয় বর্জ্য ও অব্যবহার্য জিনিসপত্র প্রতিনিয়ত ফেলা হয় গন্ধেশ্বরীর বুকে। সতীঘাট এলাকায় নদীর বিস্তীর্ণ বুক জুড়ে চড়া পড়ে সৃষ্টি হয় কাশবন, খেলার মাঠ। রাজনৈতিক দলগুলির বড় সভা করার আদর্শ ময়দান হিসেবেও ব্যবহার করা হয় এই মাঠকে। আর নদী পরিণত হয় এক সংকীর্ণ নালায়। পাঠকপাড়ায় এই নদীগর্ভেই রয়েছে শহরের পানীয় জল সরবরাহের সবচেয়ে প্রাচীন আণ্ডারগ্রাউন্ড জলাধার।

বিশেষজ্ঞেরা বলেন, নিকাশি নালাগুলির জল সরাসরি নদীতে পড়ায় নদীর জল দূষিত হচ্ছে। ফলে, এই নদীর জল ব্যবহার করে পেটের ও চর্ম রোগের শিকার হচ্ছেন নদী তীরের গ্রাম ও বাঁকুড়া শহরের মানুষ।

আবহাওয়ার দিক থেকে চরমভাবাপন্ন বাঁকুড়া জেলায় প্রখর গ্রীষ্মে তাপমাত্রা যেমন ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে, তেমনি প্রচণ্ড শীতে ৭-৮ ডিগ্রিতে নেমে আসার রেকর্ড আছে। এ জেলাকে খরাপ্রবণ বলা হলেও, এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১,৪০০-১,৫০০ মিলিমিটার। বিশেষজ্ঞেরা বলেন, বছরে বর্ষার সময় মাত্র ১০০ ঘণ্টার মধ্যে এই বৃষ্টিপাতটা হয় বলে পুরোটাই নদী দিয়ে বয়ে চলে যায়। একে ধরে রাখার কোনও ব্যবস্থা নেই।

সাধারণত বার্ষিক ৭০০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাত হলে সে অঞ্চলকে খরা-অঞ্চল বলা হয়ে থাকে। সে অর্থে বাঁকুড়াকে খরা-এলাকা বলা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভৌম জলের স্তরকে উন্নত করতে পারলে তবেই জল সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে নদী-সমস্যাও মেটানো সম্ভব। সে জন্য বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এক সময় বাঁকুড়া শহর শুধু নয়, সারা জেলা জুড়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা অসংখ্য বড় বড় জলাশয় খনন করেছিলেন, প্রকৃতির জলকে ধরে রাখার জন্য। যে সময় এই পুকুর বা বৃহৎ জলাশয়গুলি খনন করা হয়েছিল সে সময় একশ দিনের কাজ বা অনুরূপ সরকারি প্রকল্প ছিল না। মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজনেই তা করিয়েছিল।

সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, যে জেলার শালতোড়া, ছাতনা, বাঁকুড়া ১ ও বাঁকুড়া ২ ব্লক এলাকার বনভূমি এবং শুশুনিয়া পাহাড় এলাকায় বৃষ্টির জলের বেশির ভাগটাই গন্ধেশ্বরী নদীতে মেশে। কয়েক বছর আগে এই জল সংরক্ষণের জন্য বনবিভাগের উদ্যোগে কিছু জোড় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র ‘নদী বাঁচাও কমিটি’ আয়োজিত এক আলোচনায় জল সংরক্ষণ প্রসঙ্গে রাজস্থানের আলোয়ার জেলার খরা অঞ্চলের উদাহরণ তুলে ধরেন। সেখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাত্র ৩০০ মিলিমিটার, অথচ বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে তারা অসাধ্য সাধন করেছেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন রাজস্থান যদি পারে তাহলে আমরা পারব না কেন?

লেখক সাংবাদিক ও গন্ধেশ্বরী নদী বাঁচাও কমিটির যুগ্ম সম্পাদক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gandheswari River Dying River Bankura
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE