Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

লক্ষ্মী মুর্মুর ইস্কুল

শুধু ধর্ষণ কেন, মনীষা পৈলানের মতো যে মেয়েরা অ্যাসিডে আক্রান্ত, তাঁরাও গ্রামে ফিরতে পারেননি। অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়ে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন। এ রাজ্যে ধর্ষণ-নির্যাতনের মোকাবিলা মানে, মেয়েটাকে সরিয়ে দেওয়া। তাঁকে মুছে দিলেই যেন সমস্যা ঘুচে গেল।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৯ ০০:৩৪
Share: Save:

যে  মেয়েদের ধর্ষিত, নির্যাতিত হওয়ার খবর কখনও প্রকাশিত হয়েছে, আলোড়ন ফেলেছে, খবর থেকে হারিয়ে যাওয়ার পরে তাঁরা কেমন আছেন? দেশের নানা রাজ্যে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন দিল্লির এক সাংবাদিক। এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গেও। কিন্তু বেশ কিছু এমন মেয়েকে খুঁজেই পাননি। বলেছিলেন, ‘‘কেবল পশ্চিমবঙ্গেই দেখলাম, যে মেয়ে ধর্ষিত হয়েছেন, সে আর গ্রামে থাকেন না। অনেকের পরিবারও নিরুদ্দেশ। কোথায় আছে, তা-ও কেউ বলতে পারেন না।’’

শুধু ধর্ষণ কেন, মনীষা পৈলানের মতো যে মেয়েরা অ্যাসিডে আক্রান্ত, তাঁরাও গ্রামে ফিরতে পারেননি। অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়ে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন। এ রাজ্যে ধর্ষণ-নির্যাতনের মোকাবিলা মানে, মেয়েটাকে সরিয়ে দেওয়া। তাঁকে মুছে দিলেই যেন সমস্যা ঘুচে গেল।

ব্যতিক্রম কি নেই? আছে বইকি। লক্ষ্মী মুর্মু স্মৃতি শিশু বিদ্যালয়।

বাঁকুড়ার এক দরিদ্র ব্লক ছাতনা, তার অতিদরিদ্র আদিবাসী গ্রাম ছাচনপুর। সরকারি খাতায় গ্রামও নয়, শুয়ারা বাকরা গ্রামের একটা পাড়া। সেই আদিবাসী পাড়ার ইস্কুল শুরু সকাল আটটায়। ঢোলা নীল প্যান্ট বা স্কার্ট, মেরুন চেক-কাটা জামা, পিঠে স্কুলব্যাগ, পায়ে চপ্পল, কচি গলার কলতান। বছর তিনেক হল এই পাড়ার পরিচয়, ইস্কুলপাড়া।

লক্ষ্মী মুর্মু কিন্তু ছাচনপুরের মেয়ে নন। তাঁর বাড়ি ছিল শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে হাপানিয়া গ্রামে। বাবা ফরেস্ট গার্ড। যখন ষষ্ঠ শ্রেণি, ছুটিতে হস্টেল থেকে বাড়ি এসেছিল মেয়ে। ভিডিয়ো শো দেখে ফিরছিল দুই সঙ্গীর সঙ্গে। সে যাত্রা আর ঘরে ফেরা হল না। লক্ষ্মীর সংজ্ঞাহীন দেহ নিয়ে যেতে হয়েছিল হাসপাতালে। গণধর্ষণে অভিযুক্ত হয়েছিল ষোলো জন। লক্ষ্মীর বয়স তখন তেরো।

তার পর যা যা হল, সবই ছকে বাঁধা। এলাকার নেতা দাঁড়ালেন অভিযুক্তদের পাশে, মেয়ে গ্রামে ফিরতে পারলেন না। আলাদা এইটুকু, বাবা কেস তুলে নিতে চাইলেও মেয়ে রাজি হননি। মাধ্যমিকের পর লক্ষ্মী কাজ নিলেন একটি অসরকারি সংস্থায়। কৃষির প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ। কিন্তু যাদের খেতে কাজ, তাদের মধ্যেও রয়েছে ধর্ষকদের ভাই-ভেজ। লক্ষ্মীকে সরানোর চাপ দিতে থাকল তারা। সংস্থার কর্তারা পড়ল ফাঁপরে। কাজের এমন ‘ফিল্ড’ নষ্ট হবে? এক দিন সংস্থার কর্তা স্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠকে ঢুকতে দিলেন না লক্ষ্মীকে।

সে দিন যে মেয়েটি রুখে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘কেন লক্ষ্মীদি থাকবে না মিটিংয়ে?’’ তাঁর নাম রেবা মুর্মু। বাড়ি ছাচনপুর, গ্রামের প্রথম মাধ্যমিক পাশ মেয়ে (২০১১’তেও শুয়ারা বাকরা গ্রামে মেয়েদের সাক্ষরতা চুয়াল্লিশ শতাংশ)। ডানপিটে, খেলাধুলোয় চৌকস, শাড়ি দু’চক্ষের বিষ, প্যান্টালুন পরেন। রেবাও একই সংস্থার কর্মী। সতেরো-আঠেরোর দুই মেয়ে, রেবা আর লক্ষ্মী, পায়ে হেঁটে পাহাড়ি এলাকার চোদ্দোটি গ্রামে গিয়ে গিয়ে তৈরি করেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। গ্রামবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি হয়েছে অফিসঘর। এত শ্রমে যে মেয়ে দল তৈরি করেছেন, দলের মিটিংয়ে তিনি বাদ পড়বেন কেন? জবাবে সংস্থার কর্তা বলেছিলেন, ‘‘এক ফোঁটা কেরোসিনের জন্য এক বালতি দুধ নষ্ট করব?’’ তিন দশক পরেও রেবার চোখ জ্বলে। ‘‘বললাম, আজ ওকে কেরোসিন মনে হচ্ছে, কাল আমাকে মনে হবে।’’ কপর্দকহীন দুই তরুণী কাজ ছেড়ে দিলেন। দু’জনে ফিরলেন ছাচনপুরে। রেবার বাড়িতে থেকে কোর্টে হাজিরা দিতে বাঁকুড়া যেতেন লক্ষ্মী। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে একটা চাকরিও জুটল, যাতায়াত ৪০ কিলোমিটার।

মামলার রায় বেরোল। ষোলো জন অভিযুক্তের দু’জন ফেরার, বাকি চোদ্দো জনের বারো বছর জেল। গোটা তল্লাট বাক্‌রুদ্ধ। এতগুলো পুরুষ, দামি উকিল, নামী নেতার বিরুদ্ধে একা একটা মেয়ে কিছু করতে পারবে, কেউ ভাবেনি। ফের শুরু হল ধমক-চমক। রেবার বাবা ভয় পেলেন। বাইরের মেয়ের জন্য কি নিজের সর্বনাশ করব?

ফের ঘর ছাড়তে হল। সেটা ২০০১, ইস্কুলপাড়া তখন জঙ্গল। সামান্য টাকায় কিছু জমি কিনে দুই মেয়ে নিজেরাই ইট গাঁথলেন, টিন ছাইলেন। বাড়ির উল্টো দিকে এক ফালি জমিতে খেজুরগুঁড়ির উপর তালপাতার ছাউনি খাড়া করলেন। ঘর ঘর থেকে শিশুদের হাত ধরে এনে সেখানে সকাল-বিকেল পড়াতে শুরু করলেন লক্ষ্মী। রেবা শুরু করলেন ‘ছাচনপুর মহিলা কল্যাণ সমিতি’ গড়ে তোলার কাজ। দু’এক জন করে শিশু থাকতে শুরু করল রেবা-লক্ষ্মীর বাড়িতে। ২০১৪ সালে লক্ষ্মীর ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে যখন দু’জনে রওনা দিলেন কলকাতায়, তখন বাইশ জন শিশুকে বাড়ি পাঠাতে হয়েছিল। ছ’মাস পরে ফিরলেন রেবা। একা। আজ সেই বাড়িতে থাকে এগারো জন শিশু। সকালে ফ্যানভাত আলুমাখা খেয়ে স্কুলে যায়। রাস্তার ও পারেই স্কুল।

লক্ষ্মী মুর্মু স্মৃতি শিশু বিদ্যালয় (প্রতিষ্ঠা ২০১৫) সরকারি নথিতে এখনও ‘স্কুল’ হয়নি। তার সাতাশি জন পড়ুয়ার (অর্ধেক আদিবাসী, প্রায় সকলেই গরিব) অধিকাংশের নাম লেখানো সরকারি স্কুলে। সেখানে ওদের তকমা জোটে ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’। কেন আদিবাসী শিশুদের পড়াশোনা হয় না, এলাকার সরকারি ইস্কুলের শিক্ষকদের কাছে তার লম্বা ফিরিস্তি মিলল। যথা, বাবা-মা সচেতন নয়, রোজ স্কুলে পাঠায় না, বাড়িতে পড়ছে কি না দেখে না। সে সব শুনে এসে দাঁড়াতে হয় লক্ষ্মীদির স্কুলে। এখানে মুর্মু, টুডু, সরেন, হেমব্রম শিশুরা যুক্তাক্ষর-কণ্টকিত গদ্য গড়গড় করে পড়ে। ওরা ক্লাস টু। ‘‘গরিবের ছেলেও বিদ্বান হয়, ধনীর ছেলের বিদ্যা হয় না। পরিবেশটা দিতে হবে’’, বললেন রেবা।

কিন্তু লক্ষ্মী মুর্মুর নামে ইস্কুল কেন?

‘‘তার মধ্যে লড়াই করার ইচ্ছে ছিল, প্রতিবাদের সাহস ছিল।’’

সত্যিই তো! পরিবার, প্রতিবেশী, কর্মক্ষেত্রে প্রবল বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে যে ন্যায় আদায় করতে পারে, যে অন্যকে অক্ষরজ্ঞান দান করে লড়াই করার ক্ষমতা জোগায়, সে-ই তো শিক্ষক।

ছাচনপুরের স্কুলের নামটাই তো একটা শিক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rape Purulia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE