Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
নাগরিকত্ব ছাড়া এখন আর মেরুকরণের অস্ত্র নেই

পাল্টা প্রশ্নের যুদ্ধকৌশল

এ বার নাগরিকত্ব বিল, এনআরসি নিয়েও একই রকম বিতর্ক শুরু হবে। এনআরসি-তে অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত মুসলিমদের কি বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে? বাংলাদেশ কি তাঁদের ফেরত নিতে রাজি?

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১৬
Share: Save:

যুদ্ধের অন্যতম কৌশল হল, টোপ দেখিয়ে শত্রুপক্ষকে ফাঁদে ফেলতে হবে। যুদ্ধে সেই টোপ হবে বিপক্ষের সামনে জয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে বিভ্রম তৈরি করা। নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ বোধ হয় প্রাচীন চিন দেশের এই যুদ্ধকৌশল অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। তাঁরা এক পা করে এগোন। এবং সঙ্গে বিরোধীদের জন্য ফাঁদ পেতে যান। কী আশ্চর্য, প্রতি বারই নিয়ম করে হয় বিরোধীরা ফাঁদে পড়ার ভয়ে এগোতেই পারেন না, আর নয়তো, সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন। নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিল থেকে সার্জিকাল স্ট্রাইক, লোকসভা ভোটের আগে পুলওয়ামা-বালাকোট, দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফিরে কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ, অযোধ্যার রামমন্দির থেকে এ বারের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল— বিরোধী শিবিরের জন্য প্রতি পদে ফাঁদ পেতে রাখছেন মোদী-শাহ জুটি।

৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করার বিরোধিতা হলে মোদী-শাহ প্রশ্ন তুলেছিলেন, আপনারা কি মানেন না কাশ্মীর ভারতের অখণ্ড অংশ? নোট বাতিলের সময় মোদীর পাল্টা প্রশ্ন ছিল, আপনারা কি কালো টাকার মালিকদের পক্ষে? না কি আপনাদের সুইস ব্যাঙ্কে কালো টাকা রয়েছে! সার্জিকাল স্ট্রাইক থেকে বালাকোটে বায়ুসেনার হামলা— সাফল্য নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন উঠতেই মোদীরা বিরোধী শিবিরকে ‘রাষ্ট্র-বিরোধী’, ‘সেনা-বিরোধী’, ‘পাকিস্তান-পন্থী’ বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন। অযোধ্যায় মন্দির তৈরি হতে চললেও, বিরোধীরা মুখ খুলতে পারছেন না। খুললেই প্রশ্ন উঠবে, আপনারা কি অযোধ্যাকে রামের জন্মভূমি বলে মানেন না? কোন রাজনীতিকের বুকের পাটা রয়েছে যে বলবেন, রাম ঐতিহাসিক চরিত্র নন!

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলেও সেই ফাঁদ পাতা। তৃণমূল নাগরিকত্ব বিলের বিরোধিতা করলে প্রশ্ন আসছে, আপনারা কি অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় দিয়ে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে চান? মুসলিমদের কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে জিজ্ঞাসা করলে প্রশ্ন আসছে, বাঙালি শরণার্থীরা এ দেশের নাগরিকত্ব পেতে চলেছেন। তৃণমূল কি তা চায় না?

আপাত ভাবে অনেকেরই মনে হচ্ছে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এনে বিজেপি নিজেরই কবর খুঁড়ছে। অসম আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, অনুপ্রবেশকারী হটাও। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়ে যাওয়া ১৯ লক্ষের মধ্যে সিংহভাগই হিন্দু। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এনে সেই হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তা হলে অসমের সমস্যার কী সমাধান হল? গোটা উত্তর-পূর্বেও এর বিরোধিতা চলছে। কংগ্রেস অঙ্ক কষছে, বিজেপি শুধু বিজেপির নয়, উত্তর-পূর্বে শরিকদেরও পাট গোটানোর জো করছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, গোটা দেশেই এনআরসি হবে। হবেই। পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি নিয়ে আতঙ্ক তুঙ্গে। দেশভাগ বা তার পরে ও-পার থেকে আসা মানুষ তো বটেই, এ-পার থেকে আসা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক। নিজেকে দেশের নাগরিক বলে প্রমাণ করা যাবে তো? তিন উপ-নির্বাচনে বিজেপির হারেও এই এনআরসি-আতঙ্ক কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তৃণমূল নেতৃত্ব ২০২১-এর আগে বিজেপির এই বোকামি দেখে মজা পাচ্ছেন। বাংলা-অসমে বিপক্ষের এই বিভ্রমটাই বিজেপির টোপ।

মোদী-শাহ বোকা নন। গোটা দেশে এনআরসি-র কথা বলছেন অমিত শাহ। অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকার মতো বেছে বেছে চিহ্নিত করার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন তিনি। অসমে মাত্র তিন কোটি মানুষের জন্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকা খরচ করে এনআরসি তৈরি হয়েছে। সেই এনআরসি ত্রুটিমুক্ত হয়নি বলে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরাই দাবি তুলছেন। তা হলে গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করতে কত অর্থ-সময় ব্যয় হবে? সেখানে কি ভুল-ভ্রান্তি বার হবে না? তা হলে কেন তাঁরা এনআরসি নিয়ে মরিয়া?

আসলে এটাই ফাঁদ। এনআরসি নিয়ে প্রশ্ন তুললেই বিজেপি মুসলিম তোষণের, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলবে। কাজের কাজ না হলেও এ নিয়ে ২০২৪-এর লোকসভা ভোট পর্যন্ত যে মেরুকরণের রাজনীতি চলবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অমিত শাহ বেছে বেছে ২০২৪-কেই গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার সময়সীমা ঠিক করেছেন।

বিজেপির হাতে এখন এনআরসি-নাগরিকত্ব বিল ছাড়া আর মেরুকরণের অস্ত্র নেই। এত দিন ছিল রামমন্দির-বাবরি মসজিদ। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অস্ত্রটি সরযূ নদীর জলে ভেসে গিয়েছে। বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের দীর্ঘ দিনের ৩৭০ রদের অস্ত্রও ছোড়া হয়ে গিয়েছে। এ বার তাই এনআরসি দরকার। বিজেপি এনআরসি-কে মেরুকরণের হাতিয়ার করতে কতখানি মরিয়া, অমিত শাহের জবাবই তার প্রমাণ। অসমে এনআরসি তৈরির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ছিল। বাংলা বা গোটা দেশে এনআরসি-র ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কী? সংসদে এ প্রশ্নের মুখে অমিত শাহের উত্তর, “কোনও প্রেক্ষাপট নেই। আমাদের ইস্তাহারে রয়েছে। সেটাই প্রেক্ষাপট।”

মোদীর সাফল্য হল, রাজনীতির আজেন্ডা তিনিই ঠিক করেন। পর পর দুই লোকসভা ভোটে একই ব্যক্তি নিজের মতো আজেন্ডা তৈরি করছেন, এমন উদাহরণ আর প্রায় নেই। বিরোধীদের ব্যর্থতা হল, বিজেপি নেতৃত্বের ফাঁদে পা দিয়ে, মোদীর পছন্দের বিষয়েই তর্কে নেমে পড়া। লোকসভা ভোটের আগে পুলওয়ামা-বালাকোট নিয়ে বিরোধী শিবির প্রশ্ন তুলতেই মোদী গোটা লোকসভা ভোটের বিতর্ক এক মিনিটে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমে নিয়ে গিয়েছিলেন। পেয়ালার চা থেকে চামচে করে মরা পিঁপড়ের মতো অর্থনীতির দুর্দশা, বেকারত্ব, চাষিদের সঙ্কট, নোট বাতিল, জিএসটিতে গলদের মতো অপ্রিয় বিষয় তুলে ফেলে দিয়েছিলেন। তার বদলে তুললেন এমন বিষয়, যা আমজনতার দেশপ্রেমের আবেগে সুড়সুড়ি দেয়।

লোকসভা ভোটে রাহুল গাঁধী নরেন্দ্র মোদীর সেই পাতা ফাঁদেই পা দিয়েছিলেন। রাহুল নিজেকে শিব-ভক্ত প্রমাণ করতে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরলেন। মোদী হয়তো অলক্ষ্যে মুচকি হেসেছেন। উগ্র হিন্দুত্ব বনাম নরম হিন্দুত্বের লড়াই তাঁর চেনা মাঠ। বিজেপি চাইছিল, ‘প্রেসিডেন্সিয়াল’ নির্বাচন হোক। এক দিকে মোদী, অন্য দিকে রাহুল। কারণ সিংহভাগ বিজেপি শাসিত রাজ্যে স্থানীয় বিষয় নিয়ে লড়তে গেলে বিজেপিরই সমস্যা ছিল। তাই বিষয় নয়, ব্যক্তিত্বের লড়াই চাইছিলেন মোদী। রাফাল-চুক্তি নিয়ে মোদীর স্বচ্ছ ভাবমূর্তিতে কালি ছেটাতে গিয়ে রাহুল সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। রাফাল নিয়ে রাহুল বনাম বিজেপি তর্ক তুঙ্গে উঠেছে। রাহুলের মনে হয়েছে, রাফাল-অস্ত্র আরও ধারালো হচ্ছে। বাস্তবে গ্রামের জনজীবনে রাফাল কোনও ঢেউ তোলেনি। মোদী বললেন, বিরোধীরা আসলে শুধু তাঁকে হটাতে জোট বেঁধেছেন। আমজনতা মোদী ও রাহুলের তুলনা করে মোদীকে বেছে নিয়েছেন।

এ বার নাগরিকত্ব বিল, এনআরসি নিয়েও একই রকম বিতর্ক শুরু হবে। এনআরসি-তে অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত মুসলিমদের কি বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে? বাংলাদেশ কি তাঁদের ফেরত নিতে রাজি? যদি ফেরত পাঠানো না-ই যায়, যদি অ-মুসলিমদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়াই হয়, তা হলে ঘটা করে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে এনআরসি করে কী লাভ? বিরোধীরা এ প্রশ্ন তুললেই বিজেপি মুসলিম তোষণ, অনুপ্রবেশকারীদের মদত দেওয়ার অভিযোগ তুলে বাকি সব প্রশ্ন খারিজ করে দিচ্ছে।

এই গোটা বিতর্কে পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে অর্থনীতির করুণ হাল। আর্থিক বৃদ্ধির হার কমছে। বাজারে চাহিদা নেই। লগ্নি আসছে না। রফতানির বাজারেও মন্দা। চাষিরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না। সরকারি টাকায় কত দিন অর্থনীতি সচল রাখা যাবে, তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ। মোদী সরকারের অর্থনীতির পরিচালনার দিকে আঙুল উঠছে। প্রশ্ন উঠছে, মোদী অর্থনীতির বিষয়ে কাদের থেকে বুদ্ধি নিচ্ছেন? আদৌ কি তিনি কারও থেকে বুদ্ধি নেন? মোদী-শাহের রাজনীতির বুদ্ধি নিয়ে অবশ্য কোনও প্রশ্ন নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE