Advertisement
E-Paper

পুরাতনের শিক্ষা

নূতন বৎসর কি পুরাতনের নিকট এই ধর্মের পাঠ লইবে? প্রমাণ করিবে যে, পুরাতনের মধ্যেই নূতন থাকে, তাহাকে কেবল বাহির করিয়া আনিতে হয়।

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:২০

প্রতিটি নূতনই বহিয়া চলে অনন্ত পুরাতনের স্মৃতিচিহ্ন। সেই চিহ্ন কখনও প্রকট, কখনও ইন্দ্রিয়াতীত প্রচ্ছন্ন। কিন্তু, নূতনের মধ্যে পুরাতনের, বর্তমান বা ভবিষ্যতের মধ্যে অতীতের, উপস্থিতি অমোঘ। ক্যালেন্ডারের পাতায় নূতন বৎসর আসিল। দুনিয়া শপথ লইল, জীর্ণ যাহা কিছু, সব ভুলিয়া নূতন ভাবে শুরু করা যাউক। নববর্ষের শপথ বস্তুটি বিচিত্র। শতকরা নিরানব্বই জন মানুষের ক্ষেত্রে মাত্র অল্প কয়েক দিনেই সেই শপথকে ভেদ করিয়া ফিরিয়া আসে পুরাতন, জীবন যথাপূর্বম্ চলিতে থাকে। ভারতীয় সমাজও, ধরিয়া লওয়া চলে, নূতন বৎসরে পুরাতনের ধারাই অব্যাহত রাখিবে। কিন্তু, কোন পুরাতন? কসবার রঞ্জন সেনের পুরাতন, না কি কাশ্মীরের অনন্তনাগ গ্রামের একমাত্র পণ্ডিত পরিবারের সদ্য-অনাথ কিশোরদের পুরাতন?

রঞ্জনবাবুর নামে অভিযোগ, পাড়ারই একটি শিশু তাঁহার পায়রা চুরি করিয়াছে, এই সন্দেহে তিনি এবং তাঁহার পরিবারের অন্য সদস্যরা শিশুটিকে মারধর করেন, এবং ঘটনাক্রমে তাহার কয়েক ঘণ্টা পরে শিশুটির ঝুলন্ত দেহ আবিষ্কৃত হয়। শিশুটি তাঁহাদের পড়শি, রঞ্জনবাবুর পৌত্রের সমবয়সী, বন্ধু ছিল। আর, কাশ্মীর উপত্যকায় যখন পণ্ডিত পরিবারের আর অবশিষ্ট নাই বলিলেই চলে, তখনও মহারাজ কৃষ্ণন কাউল অনন্তনাগ ছাড়িয়া জম্মুতে নামিয়া আসিতে সম্মত হন নাই। তিনি তাঁহার গ্রাম, সেই গ্রামের মুসলমান পড়শিদের ছাড়েন নাই। গত বৎসর কৃষ্ণনের মৃত্যু হয়। কয়েক দিন পূর্বে তাঁহার স্ত্রীও বিদায় লইলেন। থাকিল কয়েকটি অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান। তাহাদের লইয়া যাইতে জম্মু হইতে আত্মীয়রা আসিতেছেন। কিন্তু, ছেলেমেয়েগুলি অনন্তনাগ ছাড়িতে নারাজ। মুসলমান পড়শিরাই তাহাদের নিকট আত্মীয়ের বাড়া। তাহারা সেই পড়শিদের আঁকড়াইয়া থাকিতে চাহে। পড়শিরাও সমান আগ্রহে, ভালবাসায় তাহাদের আঁকড়াইয়া আছেন। উপত্যকায় দীর্ঘ এবং সুতীব্র সংঘাতেরই পটভূমিকায়। দুইই ভারত। দুইই ২০১৮ সালের পয়লা জানুয়ারির প্রতি গত বৎসরের উত্তরাধিকার। এখন প্রশ্ন, বর্তমান তাহার অতীতের কোন পরিচয়টিকে বাছিবে? প্রথম পরিচয়টি বিদ্বেষ, ঘৃণা, সন্দেহে লাঞ্ছিত। যে হীন আবেগে শ্রেণিবিদ্বেষের গন্ধটি প্রায়শ অতি প্রকট। হয়তো, ‘নিম্নতর শ্রেণি’-র, ‘অপর’ পরিসরের শিশু আপন বাড়ির শিশুর বন্ধু হইয়া উঠিলে ‘ভদ্রলোক’-এর বিদ্বেষ আরও কয়েক গুণ বাড়িয়া যায় কোনও না কোনও উপলক্ষে সেই ঘৃণা হিংস্রতার রূপ লয়। বর্তমান ভারতে হিংস্রতা এমনই ‘স্বাভাবিক’ হইয়াছে যে বিদ্বেষকে হিংস্রতায় বদলাইয়া দিতে আর বিশেষ ভাবিতে হয় না।

এই বিদ্বেষ ভারতের পরিচিত, কিন্তু দুই যুযুধান, সদা-বিবদমান গোষ্ঠীর সদস্যের মধ্যে অন্তরের টান বিরল। লক্ষণীয়, সেই বিরল সম্প্রীতি, আন্তরিকতাও কিন্তু বিদ্বেষের পাঁকেই জন্মাইতে পারে। অনন্তনাগের পণ্ডিত পরিবারটির তাহার মুসলমান পড়শিদের প্রতি টান, অথবা পড়শিদের সেই পরিবারের প্রতি মমত্ব কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের বিবাদ থামিবার জন্য অপেক্ষা করে নাই। ‘ভদ্রলোক’-এর নাতির সহিত শ্রমজীবীর সন্তানের বন্ধুত্ব গড়িয়া উঠিতে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করিতে হয় নাই। এই সম্প্রীতিই স্বাভাবিক, মানুষের মন নিজস্ব গতিতে এই দিকেই ধাবিত হয়। সেই স্বাভাবিক গতি রোধ করে সমাজের অস্বাভাবিকতা— হিংসার, বিদ্বেষের আবহ। সেই আবহের উপরে উঠিতে পারা, চেতনার শক্তিতে ক্রমে সেই সমাজকে প্রীতির পথে ফিরাইয়া আনাই মানুষের ধর্ম। নূতন বৎসর কি পুরাতনের নিকট এই ধর্মের পাঠ লইবে? প্রমাণ করিবে যে, পুরাতনের মধ্যেই নূতন থাকে, তাহাকে কেবল বাহির করিয়া আনিতে হয়।

New Year Old Memories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy