Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
ভাগ্যিস এ রাজ্যে জন্মেছি

গোটা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের চেতনার মৌলিক তফাত আছে

ভাল প্লেসমেন্ট, বড়সড় মাইনের চাকরি কিংবা যঃ পলায়তে স জীবতি মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশ ছাড়তে পারলেই হল।

সংস্কৃতি: নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে মিছিলে শামিল কলকাতা, ১০ জানুয়ারি, ২০২০

সংস্কৃতি: নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে মিছিলে শামিল কলকাতা, ১০ জানুয়ারি, ২০২০

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর বাইরের গুন্ডাদের আক্রমণের কথা শুনে ও পড়ে এবং জখম হওয়া ছাত্রছাত্রীদের দেখে অনেকের মতোই আমিও ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ ও বিমর্ষ হয়েছি। শিক্ষক হিসেবে সেটাই স্বাভাবিক। আর ওদের মা-বাবাদের দুশ্চিন্তায় আমরা অনেকেই ভাগীদার। এই ঘটনাবলি পেরিয়ে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কেন্দ্রীয় শাসক দলকে ফ্যাসিবাদী আখ্যা দেওয়া, বিশেষত এই রাজ্যে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাওয়া এবং নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বিক্ষোভ, সবই এক অশান্ত সময়কে চিহ্নিত করছে। কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা অন্য আরও একটি কারণে। সেই দুশ্চিন্তার আড়ালে রয়েছে কিছু প্রশ্ন, যার উত্তর সহজ নয়।

কাজের সূত্রে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। মোটামুটি ভাবে উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের, রাজনীতির, ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ ও উষ্মা পেরিয়ে হিন্দি বলয়ে বারে বারে গিয়ে দেখেছি, এ চত্বরের অনেক ন্যায্য ক্ষোভের অনুরণন ওখানে পৌঁছচ্ছে না। ওখানে অনেকেই আমাদের মতো চিন্তাভাবনা করেন না। জেএনইউয়ের বা অন্য দু’একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘটনা নিয়ে নিশ্চয়ই বেশ কিছু উচ্চমেধা অধ্যুষিত প্রতিষ্ঠানে অনেকে পথে নেমেছেন, কিন্তু জাতীয় স্তরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনে এই বিক্ষোভ যথেষ্ট দাগ কাটেনি। ছাত্রছাত্রীদের কথাই যদি বলি, দেশের এক বিশাল অংশের ছাত্রছাত্রী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক পয়সাকড়ি দিয়ে পড়ছেন। তাঁরা কখনও কোনও ভাবে সমাজচেতনামূলক কোনও ধরনের কাজ, বিবাদ-বিতর্ক, রাজনৈতিক প্রতিরোধে যোগ দেন না। ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নাগরিকত্ব আইন, এই লিস্ট, সেই লিস্ট, কোনওটাই তাঁদের চিন্তায় তেমন কোনও দাগ কাটে না। ভাল প্লেসমেন্ট, বড়সড় মাইনের চাকরি কিংবা যঃ পলায়তে স জীবতি মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশ ছাড়তে পারলেই হল।

সব মানুষকে কখনওই এক ছকে বাঁধব না। যেমন বারাণসীর একটি ভারতবিখ্যাত মন্দিরের শুদ্ধ শাকাহারী মোহান্তজি সম্প্রতি বললেন, জেইউ বা জেএনইউয়ে সমাজসচেতন ছাত্রছাত্রীরা পড়ে, তাই তারা প্রতিবাদ করার সাহস রাখে। আবার এখানে কারও কারও মতে জেইউতে শুধু গন্ডগোলই হয়। কিন্তু এটা মানতেই হবে যে হিন্দি বলয় মূলত হিন্দু বলয়। সেখানে যে সব মানুষ গোঁড়া ধর্মাচারে বিশ্বাসী, তাঁরা এ দেশের দীর্ঘ ঐতিহাসিক পটভূমিতে হিন্দুদের উত্থানপতন আঁকড়ে ধরে পথ চলেন। তাঁরা এক ধরনের শিক্ষা, বিবর্তন এবং চেতনার আধার। তাঁদের একটা বিরাট অংশই বিশ্বাস করেন যে, সংখ্যাগুরুদের রক্ষাকবচ প্রয়োজন। এটাই তাঁদের জাতীয়তাবাদের ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একটা কথা খুব মনে হয়। এই দেশটার জাতীয়তাবোধ হয়তো উপচে পড়েছিল এক সময়। তখন দেশটার একটা সাধারণ শত্রু ছিল: ইংরেজ শাসক। তাই তাকে ধূলিসাৎ করার জন্য সবাই এক হবে, এটাই ছিল আদর্শ। আজ আর এক জন সাধারণ শত্রুর প্রয়োজন, না হলে জাতীয়তাবোধ দানা বাঁধছে না। এ বার, একমাত্র তৃতীয় মানুষটিকে লাঞ্ছিত করার জন্য যদি প্রথম দু’জন যূথবদ্ধ হন, সেই জাতীয়তাবোধ বা জাতীয়তাবাদকে কী চোখে দেখব আমরা, সেটাই প্রশ্ন।

এমন একটা ‘জাতীয়তাবোধ’ মানুষের মনকে দখল করলে তিনি কী ভাবে ভাবেন, তার একটা উদাহরণ দিই। অর্থনীতির আকাশে কালো মেঘ, নাগরিকত্ব আইনে অনিশ্চয়তার বাতাবরণ, অসমে নাগরিক পঞ্জিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম না ওঠা, সম্প্রতি কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় শাসক দলের ব্যর্থতা, এই সব নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা হল বারাণসীর একটি ভাড়া করা গাড়ির চালকের সঙ্গে। তিনি আমার অনেক দিনের পরিচিত। শান্ত, সুমিষ্টভাষী। মোদী সরকারের বড় সমর্থক। তাঁকে যা-ই বলবেন, তিনি জবাবে বলবেন— মোদীজি এবং যোগীজি ‘আমাদের রক্ষাকর্তা’। আপনি গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের কথা বললে, তিনি বলবেন ‘এনকাউন্টার’ই ঠিক রাস্তা। তাঁর বিচারে ধর্মীয় বিশ্বাস আর রাজনীতি একাকার হয়ে যায়। এবং তাঁর বিশ্বাস— পশ্চিমবঙ্গে ‘বিদেশি’র সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এটা একটা ‘ফোরেন ল্যান্ড’ হয়ে যাচ্ছে।

এর সঙ্গে সঙ্গে বলা দরকার, দেশে এবং দেশের বাইরে অনাবাসীদের মধ্যে খুবই উচ্চশিক্ষিত অনেককে দেখেছি, যাঁদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে বারাণসীর গাড়িচালকের খুব একটা গরমিল নেই। যখন আঞ্চলিক রাজনীতি নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন করেছি, উত্তর এসেছে— স্থানীয় ‘ভ্রষ্টাচারী’ সব দলেই থাকে, কিন্তু সেই সব সমস্যা যতই হোক, যেমনই হোক না কেন, আমাদের ‘রক্ষাকবচ’টা অবশ্যই চাই। ৩৭০ ধারা বিলোপ বা রামমন্দির প্রতিষ্ঠা, সমস্ত বিষয়েই তাই এঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত অনুত্তেজিত, স্থিতপ্রজ্ঞায় অনড়।

এই সব দেখেশুনে বলতে দ্বিধা নেই, ভাগ্যিস জন্মেছিলাম এই রাজ্যে। এখানে কোনও না কোনও ভাবে সমাজবাদের কিছুটা আদর্শ, গুরু-লঘুর মেশামিশি এবং বামপন্থী চিন্তাধারার প্রভাব বেশ জবরদস্ত। তার জন্য বামপন্থী সরকারের প্রয়োজন ছিল কি না জানি না। কিন্তু মানুষে মানুষে যে আসলে কোনও ভেদ নেই, অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজনই আসল— এই কথাটি তো অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। এর পাশাপাশি অবশ্যই আছে ‘দক্ষিণেশ্বর স্কুল অব থট’, কার সাধ্যি তাকে অবজ্ঞা করে। এই সব মিলিয়ে আমরা আমাদের শারীরিক ভাষা ও মানসিক আদল দুটোতেই একটু অন্য ধরনের বিবর্তনের উদাহরণ হয়ে আছি।

এটা খুবই সত্যি যে, আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীরা অনেকেই পৃথিবীটাকে অন্য রকম ভাবে দেখি। দীর্ঘকালের সামাজিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছোটবেলা থেকেই আমাদের জাতপাত, ধর্মাধর্ম, ছুত-অচ্ছুতের দুনিয়া থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। তাই পুজো-আচ্চার শেষ না থাকলেও অনেক অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ চট করে আমাদের বন্ধু হয়ে যায়। আর, পড়শিদের দুশ্চিন্তা দেখলে, যাদের প্রায় জন্মাবধি কাছ থেকে দেখছি তাদের একঘরে করে দেওয়ার চেষ্টা দেখলে, না বলতেই হাত তুলে প্রতিবাদ করি।

খুব সরাসরি বললে— এই রাজ্যটার চেতনা আর সারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় দেশ, জাতি, সমাজ, ঠিক-বেঠিক, ভাল-মন্দ, এ সবের ধারণার মৌলিক তফাত চোখে পড়ার মতো। আমরা এখানে যে ভাবে মানুষ হয়েছি, আমাদের যা ইতিহাস, আমরা যাঁদের অনুসরণীয় বলে ভেবেছি, যা আমাদের সামাজিক শিক্ষা, সুচেতনা, ধর্মাধর্মের বিচারবোধ, যুক্তি ছাড়া গতি নেই এমন একটা চিন্তাধারা, গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলনের সংস্কৃতি, সবটাই অন্য রকম। কিছু দিন আগে দেশের গণিত গবেষণার জন্য সুপ্রসিদ্ধ একটি প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা বলেছিলেন, দেশের সর্বত্র নামীদামি বিজ্ঞান ও গণিত প্রতিষ্ঠানে পিএইচ ডি’র জন্য গবেষণারত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বিপুল ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটা তো এমনি এমনি হয় না, আকাশ থেকেও পড়ে না।

‘যা এখানে স্বাভাবিক তা ওখানে নয়, যা ওখানে স্বাভাবিক তা এখানে নয়’— এমনই একটা ভারতে বাস করি আমরা। মন্দের মধ্যেও ভাল থাকে, ভালর মধ্যে মন্দ। তাই বাদী-প্রতিবাদী যুক্তিচর্চার ভীষণ প্রয়োজন। প্রশ্নের উত্তর যখন শুধু বিশ্বাস, তখনই দুশ্চিন্তা, সে যে বিশ্বাসই হোক না কেন। এখন প্রশ্ন হল, এই মহাসমুদ্রসম দেশটায় যুক্তিবাদ কি দ্বীপের মতো বেঁচে আছে, না কি দ্বীপের মতো ভাসমান সব বিবাদ-বিতর্কের ও পারে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে বিশ্বাসপ্রসূত সিদ্ধান্ত? সেটা নিয়েই সংশয়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হিসেবে খানিকটা আশ্বস্ত হই। কিন্তু ভারতবাসী হিসেবে হতে পারি কি? জানি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE