Advertisement
E-Paper

রাজনীতির মন থাকতে নেই!

ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ভাষায় কথা বলেন, তা ক্ষমতার অভিমুখ ধরে চলা রাজনীতির ভাষা। ডোনাল্ড ট্রাম্প জানেন তাঁর দেশের অনেক নাগরিকই এই ভাষা শুনতে চান, সে ভাবেই তৈরি করা হয়েছে তাঁদের।

অনুপম কাঞ্জিলাল

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৩৫

আলেহান্দ্রা হুয়ারেজ়, ৩৭-৩৮ বছর বয়সি এক মহিলা। সম্প্রতি মার্কিন মুলুক থেকে তাঁকে চলে যেতে বাধ্য করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। মার্কিন দেশে অবৈধ প্রবেশের ‘অপরাধ’-এ এই বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত। আলেহান্দ্রা হুয়ারেজ় মেক্সিকো থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন মাত্র ষোলো বছর বয়সে। তার পর থেকে মার্কিন মুলুককেই নিজের দেশ মনে করে তিনি থেকে যান। মার্কিন মুলুকেই তাঁর বিয়ে-সংসার-সন্তান। হুয়ারেজ়ের স্বামী মার্কিন দেশের প্রাক্তন নৌ-সেনা কর্মী। ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। তবু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন আলেহান্দ্রা হুয়ারেজ়ের উপর থেকে অবৈধ প্রবেশের তকমা তুলে নিতে সম্মত হয়নি। এমনকি মার্কিন কংগ্রেসের ৯ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এই বহিষ্কার না-করার লিখিত অনুরোধ করলেও তা গ্রাহ্য হয়নি। হওয়ার কথাও নয়, কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করেছিলেন বহিরাগতদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা করা হবে। তাঁর মতে, বহিরাগতদের জন্যই দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে, মার্কিন দেশের বৈধ নাগরিকরা নানা ভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ভাষায় কথা বলেন, তা ক্ষমতার অভিমুখ ধরে চলা রাজনীতির ভাষা। ডোনাল্ড ট্রাম্প জানেন তাঁর দেশের অনেক নাগরিকই এই ভাষা শুনতে চান, সে ভাবেই তৈরি করা হয়েছে তাঁদের। তাই আলেহান্দ্রা হুয়ারেজ় মার্কিন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তাঁর দুই কন্যা সন্তানের বিমানবন্দর চত্বরে মা-কে জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নার দৃশ্যও নিশ্চয়ই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ও তাদের রাজনীতির অনুরাগীদের বুকে কোনও মোচড় দিতে পারেনি!

রাজনীতির মন থাকে না, মন থাকতে নেই। মন থাকলে শুধু ক্ষমতার কক্ষপথ ধরে আবর্তিত হওয়া, কিংবা ক্ষমতাকে কী ভাবে আরও নিশ্ছিদ্র করতে হয় তা ভাবা ছাড়াও আরও অনেক কিছু ভাবতে হয়। তাই গল্পটা শেষ পর্যন্ত আলেহান্দ্রা হুয়ারেজ় নামের এক মহিলার জীবনের মর্মান্তিক পরিণতির গল্প নয়, গল্পটা আসলে আমাদের মনহীন রাজনীতির গল্প।যে রাজনীতির ছায়া আজ গোটা বিশ্ব জুড়ে। এই মুহূর্তে পৃথিবী জুড়েই উদ্বাস্তু সমস্যা এক ভয়াবহ আকার নিয়েছে, আর সব জায়গার রাজনীতিই সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে এক মনহীন নির্দয়তার বার্তা শোনাচ্ছে।

যেমন, এ দেশে অসম রাজ্যে রাতারাতি ৪০ লক্ষ মানুষ বৈধ নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়ে যেতেই কেন্দ্রীয় শাসক দলের রাজনৈতিক অনুগামীরা একেবারে ‘রে রে’ করে ময়দানে নেমে পড়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তাঁদের লাগাতার হুঙ্কার চলছে— এক জন অনুপ্রবেশকারীকেও রেয়াত করা হবে না, সবাইকে দেশছাড়া করা হবে। নাগরিকতার বৈধতা নির্ধারণের ধরনধারণ নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলতে চাইছেন, তাঁদের জাতীয়তাবাদবিরোধী, দেশবিরোধী বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। মনহীন রাজনীতি তার নিজের মতো করে তৈরি করে নিচ্ছে দেশপ্রেম-জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা। সেখানে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আনুগত্যই শেষ কথা, সেই আনুগত্যে টোল পড়তে পারে, এমন কোনও প্রশ্ন বা যুক্তির কোনও জায়গা নেই। তাই এই তর্ক তোলাই যাচ্ছে না যে, যদি-বা ধরে নেওয়া যায় ৪০ লক্ষ মানুষের সকলেই অবৈধ ভাবে প্রবেশ করেছেন এ দেশে, সে ক্ষেত্রে এতগুলো মানুষকে তাড়িয়ে দিলে এঁদের দায়িত্ব নেবে কে? মানুষের অস্তিত্বটাই তো অবৈধ হয়ে যেতে পারে না! মনহীন রাজনীতি এই সব প্রশ্ন শুনতে চায় না।

একই কারণে, এ দেশের একাধিক মানবাধিকার কর্মীদের বিভিন্ন রাজ্য থেকে গ্রেফতারের ঘটনায় বিতর্ক শুরু হওয়ার পর, কেন্দ্রীয় শাসক-রাজনীতির প্রবক্তারা প্রশ্ন তোলেন, যাঁরা মাওবাদী সংগঠনের কাজকর্ম সমর্থন করেন, কোন যুক্তিতে তাঁদের মানবাধিকার কর্মী বলা যায়। অর্থাৎ এই প্রশ্ন তোলার সময় এঁদের মনে থাকে না যে, সন্ত্রাস শুধু মাওবাদীরা করে না, এ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাস করার অভিযোগ আছে। এ রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে যে মৃত্যুর খবর এসেছে, তার পর পঞ্চায়েত বোর্ড তৈরি করা নিয়ে হিংসা হানাহানি, যা থেকে রেহাই মেলেনি তিন বছরের শিশুরও— তা কিন্তু মাওবাদীদের কাজ ছিল না। কিংবা গোহত্যার অভিযোগে যে রাজনীতির সমর্থকরা মানুষকে পিটিয়ে মারছেন, তাঁরাও মাওবাদী ছিলেন না। দেশের সুপ্রিম কোর্ট মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, জরুরি কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছে যে, বিরোধী স্বর গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত। তবে চার পাশের ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, মনহীন রাজনীতির অনুগামীদের কাছে গণতন্ত্রের এই সব শর্তেরও কোনও দাম নেই।

রাজনীতির যে মন নেই, তা আরও স্পষ্ট হল এই রাজ্যেরই এক রাজনীতিকের কথা থেকে। বিজেপির ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি সুখময় শতপথী সম্প্রতি তাঁর ফেসবুক পেজ-এ লিখেছেন, তাঁর রাজনীতি তাঁকে মানবিকতার ডাকে সাড়া দিতে দেয়নি। ঝাড়গ্রামের অদূরে খুন হয়ে যাওয়া তৃণমূল কর্মী চন্দন ষড়ঙ্গী ছিলেন সুখময়ের অনেক দিনের বন্ধু। তাঁর পরিবারের সঙ্গে সুখময়ের দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। তাই চন্দনের মৃত্যুর পর তাঁর খুব ইচ্ছে করেছিল, চন্দনের পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু যে হেতু চন্দনের পরিবার খুনের জন্য বিজেপি দলটিকেই দায়ী করে অভিযোগ দায়ের করেছে, সুখময় তাই বন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারেননি। সুখময় লিখেছেন, রাজনীতি কী ভাবে সম্পর্কের মাঝখানে দেওয়াল হয়ে দাঁড়ায়, আগে তিনি বুঝতে পারেননি।

সুখময়ের যন্ত্রণা আমাদের সময়কার রাজনীতির একটি বিরাট বৈশিষ্ট্যের দিকে নির্দেশ করে। কেবল বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো নয়, এই রাজনীতি কতকগুলো স্বাভাবিক প্রশ্ন করতেই আমাদের বাধা দেয়। অতিরিক্ত জনচাপে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি রুদ্ধ হতে পারে, এই সহজ কথাটা সকলেই মানবেন। কিন্তু তাই বলে ‘অতিরিক্ত’ বলতে কাদের বোঝায়, কী ভাবে তাঁদের শনাক্ত করা যায়, শনাক্ত করার পর তাঁরা কী করবেন, কোথায় যাবেন— এ সব আমরা ভাবব না? আমরা কেবল ভাবব, ওঁরা আমাদের দেশের নয়, তাই ওঁরা কোথায় যাবেন সেটা আমাদের ভাবার দরকার কী, ওঁরা মরলেই বা আমাদের কী! এইটাই তা হলে রাজনীতি?

Politics Heart Donald Trump Border
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy