মধ্যপ্রদেশে ন’টা সমীক্ষার মধ্যে তিনটেয় এগিয়ে ছিল কংগ্রেস। কিন্তু, যতখানি এগিয়ে ছিল, প্রকৃত আসনসংখ্যা তার তুলনায় ঢের কম। বাকি ছ’টা সমীক্ষা জিতিয়ে দিয়েছিল বিজেপিকে। ফলে, তাদের হিসেব আরও বেশি ভুল। তেলঙ্গানায় সব সমীক্ষাই বলেছিল, টিআরএস জিতছে। কিন্তু, চন্দ্রশেখর রাওয়ের দলের ৮৮টা আসনের জবাবে কংগ্রেসের দৌ়ড় যে থেমে যাবে মাত্র উনিশে, একটা সমীক্ষাও বলতে পারেনি। গড়ে কংগ্রেসকে ৪৭টা আসন দিয়েছিল সমীক্ষাগুলো, আর টিআরএস-কে দিয়েছিল ৫৮টা আসন।
হিসেবের ফিরিস্তি বাড়িয়ে লাভ নেই। যদি জানতে চান, কোন কোন সংস্থা সমীক্ষা করেছিল, রাজ্যওয়াড়ি পূর্বাভাস কী ছিল তাদের— ইন্টারনেটে একটু সার্চ করে নিন। যাবতীয় পরিসংখ্যান পেয়ে যাবেন। আপাতত আর দু’একটা কথা বলা যাক। যেমন, এমন একটা সংস্থাও নেই, যার সমীক্ষার ফল চারটে বড় রাজ্যের প্রত্যেকটাতে, বা নিদেনপক্ষে তিনটেতেও প্রকৃত ফলের কাছাকাছি। বুঝতেই পারছেন, এ লেখায় কোনও সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট নিউজ় চ্যানেলের নাম উল্লেখ করব না। চাইলে সার্চ করে দেখে নিতে পারেন। অবশ্য, নাম না জানলেও ক্ষতি নেই। ধরা যাক, ন’টা সংস্থার নাম যথাক্রমে চন্দ্র, পক্ষ, নেত্র থেকে অষ্টবসু আর নবগ্রহ। তার মধ্যে, নবগ্রহের সমীক্ষার ফল ছত্তীসগঢ়ে আসল ফলের সবচেয়ে কাছাকাছি গেল। তাদের হিসেব ছিল, কংগ্রেস পাবে ৫৫ থেকে ৬৫টা আসন, বিজেপি ২১ থেকে ৩১টা আসন। এই নবগ্রহই রাজস্থানে কংগ্রেসকে ১১৯ থেকে ১৪১টা আসন পাইয়ে দিয়েছিল। আবার, রাজস্থানের হিসেব মিলিয়েছিল সাত সমুদ্র নামের সমীক্ষা সংস্থা। তারাই আবার মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসকে বড় জোর ৯২টা আসন দিতে রাজি ছিল, ছত্তীসগঢ়ে বড় জোর ৩৮টা।
মোদ্দা কথা, এত টাকা খরচ করে যে সমীক্ষা হয়, যার দাপটে টানা কয়েক দিন টেলিভিশনের পর্দায় কান পাতা যায় না, সেগুলোর একটার ওপরেও আসলে ভরসা করা যায় না। এক্সিট পোলের একটা নিজস্ব মেথডোলজি আছে। কী ভাবে তার নমুনা বাছা হবে, কী ভাবে সেই নমুনার ভোটকে গোটা রাজ্যের ভোটে রূপান্তরিত করে হিসেব কষা হবে, তার পিছনে জটিল অঙ্ক রয়েছে, স্ট্যাটিস্টিকস-এর জম্পেশ তত্ত্ব রয়েছে। সে সব ঠিক না ভুল, সেই প্রশ্নে যাচ্ছি না। ভারতের মতো দেশে, যেখানে একেবারে বুথ স্তর থেকেই বৈচিত্র চোখ এবং মাথা ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো, সেখানে স্যাম্পলিং ভিত্তিক এক্সিট পোল থেকে আদৌ কিছু বোঝা সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নও আপাতত থাকুক। এই লেখায় একটাই প্রশ্ন— সান্ধ্য সংবাদের উপভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে এক্সিট পোল থেকে আমরা ঠিক কী পাচ্ছি?
উত্তরটা পাতে দেওয়ার মতো নয়। সাময়িক উত্তেজনা ছাড়া এক্সিট পোল একেবারেই কিছু দেয় না আমাদের। এমনকী, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বটুকুও নয়। ভারতে কোন টেলিভিশন চ্যানেলের রাজনৈতিক ঝোঁক কোন দিকে, এই বাজারে সেটা অনুমান করতে পারার মধ্যে বিন্দুমাত্র বাড়তি কৃতিত্ব নেই। বস্তুত, হাতে গোনা দু’একটা চ্যানেল বাদে সর্বত্রই মোদী ভজনা সার। তেমন চ্যানেলগুলোর মধ্যে যেটার আওয়াজ বেশি, ধরুন সেই চ্যানেলটার নাম পাবলিক টিভি। ধরুন, সেই চ্যানেল একটা নয়, দুটো সংস্থাকে দিয়ে দুটো এক্সিট পোল করল। তাদেরই একটা সমীক্ষায় রাজস্থানে কংগ্রেসের আসনসংখ্যা ঠেকেছিল ১৪৫-এ। মধ্যপ্রদেশেও কংগ্রেসের সর্বাধিক আসনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল এই চ্যানেলই। আবার, যে ক’টা চ্যানেল এখনও মোদী সম্বন্ধে মন্দ কথা বলার সাহস করে, তাদের মধ্যে একটির এক্সিট পোল ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেসকে সবচেয়ে কম আসন দিয়েছিল। অর্থাৎ, এক্সিট পোলের ফল না মেলার পিছনে রাজনৈতিক ছক খুঁজতে গেলেও হতাশ হতে হবে।
এক্সিট পোলের যেখানে যতটুকু মিলেছে, সেটুকু তো পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডাতেও মিলে যায়। রাজনীতি সম্বন্ধে যাঁরা নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, আরও ভাল মেলাতে পারবেন তাঁরা। অনুমানই করবেন, কিন্তু তার পিছনে তথ্যের ঠেকনা থাকবে। কাল যদি এক্সিট পোল ব্যাপারটা উঠেও যায়, খুব বড় ক্ষতি হবে না। শুধু, ফল বেরোনোর আগের কয়েক দিন উত্তেজনা পোহানো বন্ধ হবে।
যে কোনও নির্বাচনের পরই দেখবেন আলোচনা হয়, দলিতরা এ দিকে ভোট দিলেন, বা সংখ্যালঘু ভোট ওই পক্ষে গেল। কখনও ভেবেছেন, এই বিশেষজ্ঞরা জানলেন কোত্থেকে? ভোটের গায়ে তো আর ভোটারের পরিচয় লেখা থাকে না। তাঁদের জ্ঞানের উৎস এই এক্সিট পোল। অনেকে আলোচনা করার সময় এই কথাটা জানিয়ে রাখেন, অনেকে আবার বেমালুম চেপে যান। যে এক্সিট পোলে আসনসংখ্যা মেলে না, বিভিন্ন দলের মধ্যে ভোটের শতাংশ-ভাগের হিসেব মেলে না, তাতে যে দলিত, অনগ্রসর বা সংখ্যালঘু— অথবা উচ্চবর্ণের ভোটারদের— মনের হিসেবও মিলবে না, তাতে আশ্চর্য কী? কিন্তু, রাজনীতি এই মতামত মেনেই চলতে চায়। বস্তুত, এক্সিট পোল থেকে পরিসংখ্যান পাওয়া যে হেতু সহজ, রাজনীতি ক্রমে সেই হিসেবের ওপরই আরও আরও নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। তাতে মাটির সঙ্গে সংযোগ কমে, মানুষকে সংখ্যা হিসেবে দেখার প্রবণতা আরও বাড়ে। এক্সিট পোল বন্ধ হয়ে এই অভ্যাসটা যদি যায়, ক্ষতি কী?