Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
আজ যাঁরা ঘর ছাড়লেন, কাল কি ডাকলেই ফিরে আসবেন?

এক বার রং পাল্টালে

আগের লোকসভা ভোটে রাজ্যে বাম-ভোট ছিল ৩০%, যা এ বার এক ধাক্কায় প্রায় ২২-২৩% কমে হয়েছে সাড়ে সাত। ও দিকে বিজেপির ভোটের শতাংশ ১৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০। বেড়েছে সেই ২৩%-ই। তাই কেবলমাত্র বাম ভোটেই বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত, এ রকম একটা ধারণা ছড়িয়েছে।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপির পক্ষে মেরুকরণের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় চমক বিপুল বাম-ভোটের বিজেপির বাক্সে যাওয়া। দখিন দুয়ার খুলে বাম-ভোটের ছুট লাগানোর এই প্রবণতায় বাস্তবিকই চমকে গিয়েছে গোটা দেশ।

আগের লোকসভা ভোটে রাজ্যে বাম-ভোট ছিল ৩০%, যা এ বার এক ধাক্কায় প্রায় ২২-২৩% কমে হয়েছে সাড়ে সাত। ও দিকে বিজেপির ভোটের শতাংশ ১৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০। বেড়েছে সেই ২৩%-ই। তাই কেবলমাত্র বাম ভোটেই বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত, এ রকম একটা ধারণা ছড়িয়েছে। সেই সঙ্গে হাওয়ায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে যে, বামেরা নাকি তাঁদের ভোট ইচ্ছে করে দিয়ে দিয়েছেন বিজেপিকে। তৃণমূলকে হারাতে। বহুদলীয় গণতন্ত্রে একেই বলে ‘ট্যাকটিক্যাল’ বা কৌশলী ভোট। কোনও দলের সমর্থকরা যদি দেখেন যে তাঁদের জেতার কোনও সম্ভাবনাই নেই, তাঁরা তখন বিচার করতে বসতে পারেন, অন্য শক্তিশালী দলগুলির মধ্যে কে জিতলে তাঁদের ক্ষতি সবচেয়ে কম, বা কাকে তাঁরা সবচেয়ে কম অপছন্দ করেন। নেতারাও অনেক সময় সমর্থকদের বলে দেন কৌশলী ভোট দিতে। ‘ট্যাকটিক্যাল ভোটিং’ বহুদলীয় গণতন্ত্রে নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা। এবং এতে অন্যায়ও কিছু নেই। পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজে এই কৌশলী ভোট এমনকি ৪০% ছাড়াবার উদাহরণও পেয়েছি। ব্রিটেনের নির্বাচনে ১৫% কৌশলী ভোট হয়েছে সেই ১৯৭০ সালেও। আর ২০১৭-তে লেবার পার্টি আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের যোগসাজশে ২০% কৌশলী ভোট টেরেজ়া মে-র ক্ষমতাকে শুধু খর্বই করেনি, ব্রেক্সিট প্রক্রিয়াকেও বিশ বাঁও জলে ফেলেছে। যথেষ্ট পরিমাণে ট্যাকটিক্যাল ভোট হয় কানাডায়। আমেরিকার মতো দুই-দলের দেশেও ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান পার্টির প্রাইমারিতে কৌশলী ভোট হয়, এমনকি ইজ়রায়েলের মতো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সিস্টেমেও হয়।

তা বলে বাম-ভোট সচরাচর ডানপন্থী দলের খাতায় ঢোকে না নিশ্চয়ই। যদিও বাম-ভোট যে বিজেপির মতো দক্ষিণপন্থী দলের খাতায় অবলীলায় চলে যেতেই পারে, ২০১৮-র ত্রিপুরা তার সাক্ষ্য দেবে। তবে ত্রিপুরার ভোট তো কৌশলী ভোট ছিল না। ছিল অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি বা দীর্ঘ দিনের শাসকের বিরুদ্ধে ভোট। তবে, সম্পূর্ণ উল্টো মতাদর্শের পক্ষেও যে কৌশল করে ভোট দেওয়া যেতে পারে, তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হল স্পেনের ক্যাটালোনিয়া।

এ বারের নির্বাচনে ঠিক কতটা কৌশলী বাম-ভোট বিজেপির ঘরে গিয়েছে, তার হিসেব সহজ নয়। কৌশল করে বিজেপিকে ভোট না দিলেও বামেদের ভোট হয়তো কমত এ বারের নির্বাচনে। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রবাহে। কিছু হয়তো বিজেপি-হাওয়ার পক্ষে, খানিকটা তার প্রতিরোধে। ২০১৬-র বিধানসভায় বামেদের ভোট কমে দাঁড়িয়েছিল ২৬%-এ। তাই এ বার, আরও তিন বছরের ব্যবধানে, বাম-ভোট ঠিক কোথায় দাঁড়াত, সেটা জানা না গেলেও একটা অনুমানের চেষ্টা করা যেতে পারে বইকি। কংগ্রেসের ভোট ২০১৪-র থেকে কমেছে অনেকটাই। ন’ভাগের পাঁচ ভাগ হয়েছে। এই ভোট নিশ্চয়ই ঢুকেছে বিজেপি আর তৃণমূলের বাক্সে। ভাগটা যেমনই হোক না কেন। যদি আমরা ধরে নিই বাম-ভোটও কমত মোটামুটি একই অনুপাতে, তবে ২০১৯-এ বাম-ভোট ১৭%-এর আশেপাশে থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। ২০১৪-১৬ সময়সীমায় বাম-ভোটের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে এই সংখ্যাটা মানানসইও বটে। ‘লোকনীতি’-র করা নির্বাচনোত্তর সমীক্ষায় দেখছি, বাম-ভোটের প্রায় ৩১% নাকি ঢুকেছে তৃণমূলেও। এবং সেটা এই হিসেবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই আমার নিশ্চিত ধারণা, কৌশলী বাম-ভোট, যা বিজেপির ঘরে ঢুকেছে বলে সর্বব্যাপী জল্পনা, তার পরিমাণ ৯-১০ শতাংশের বেশি কিছুতেই নয়।

যেটুকু বাম-ভোট বিজেপি কিংবা তৃণমূলে গিয়েছে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক স্রোত বেয়ে, তা নিয়ে বলার কিছু নেই। সেই ভোটপ্রবাহ কী ভাবে বাড়ানো বা কমানো যায়, সেটা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলির মাথাব্যথা। আমাদের এই আলোচনা ‘ট্যাকটিক্যাল’ ভোট নিয়ে। যেটুকু ভোট বামেরা (হয়তো) কৌশল করে উৎসর্গ করেছে বিজেপিকে, তা কি চাইলেই আবার ফেরত পাবে তারা? ২০২১, ২০২৪, কিংবা ২০২৬-এর নির্বাচনে? ‘ট্যাকটিক্যাল ভোটার’-রা কি সংশ্লিষ্ট পার্টির জন্য এতটাই বলিপ্রদত্ত? না কি তাঁদের ভোটের অভ্যাসটাও বদলে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে? তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাসটা কি অপরিবর্তনীয়? না কি ভোট দেওয়ার অভ্যাস রাজনৈতিক বিশ্বাসের রসায়নেও বদল ঘটায়?

এ রাজ্যের কৌশলী বাম-ভোটের ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নানা মুনির নানা মত— ‘ফিরবে না’, ‘আধাআধি ফিরবে’, বা ‘পুরোটাই ফিরবে’। সত্যিই কী হতে চলেছে, সেটা এখনই বলা অসম্ভব। কিন্তু কী হয় পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায়? ‘ট্যাকটিক্যাল ভোট’ কি পুরোটাই ফিরে আসে পুরনো দলের খাতায়? নির্বাচনে কৌশলী ভোটের তাৎক্ষণিক প্রভাব নিয়েই যত গবেষণা। রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের ক্ষেত্রে যেন ধরেই নেওয়া হয়, কৌশলী ভোটদাতাদের দলগত পছন্দ-অপছন্দ বদলায় না এই ভোটের ফলে। সেটা ঠিক না বেঠিক, তা নিয়ে একটা ব্যতিক্রমী গবেষণা অবশ্য চোখে পড়েছে ‘পলিটিক্যাল বিহেভিয়ার’ শীর্ষক জার্নালে। সেখানে ২০১৩-র এক গবেষণাপত্রে জ়ুরিখের জোর্গেন বোলস্টাড, অক্সফোর্ডের এলিয়াস ডিনাস আর ফ্লোরেন্সের পেড্রো রিয়েরা এক উল্লেখযোগ্য বিশ্লেষণ করেছেন। ব্রিটেনের ২০০১ এবং ২০০৫-এর নির্বাচনের আগে এবং পরে একই ভোটারদের উপরে তথ্য নেওয়া হয়েছে ‘ব্রিটিশ ইলেকশন স্টাডি’ থেকে। ভোটাররা সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নম্বর দিয়েছেন তাঁদের পছন্দ অনুসারে। ০ থেকে ১০-এর মধ্যে। ‘০’ মানে চূড়ান্ত অপছন্দ, ‘১০’ মানে জোরদার পছন্দ। যত পছন্দের দল, নম্বর তত বেশি। এই স্টাডিতে এক জন ভোটারের সবচেয়ে পছন্দের দলকে দেওয়া নম্বরের গড় ৬.৫, এবং দ্বিতীয় পছন্দের দলের ক্ষেত্রে এই গড় নম্বর ৫। তথ্যভিত্তিক এই গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কোনও ভোটার কোনও দলকে ভোট দিলে সেই দলের প্রতি তার নম্বরও বেড়ে যায় খানিকটা। এই বৃদ্ধির পরিমাণটা গড়ে ০.৫৫ থেকে ০.৮৫ পর্যন্ত, বা আরও বেশি। তাই ‘ট্যাকটিক্যাল’ ভোটারদের প্রতিটা কৌশলী ভোটও একটু একটু করে তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে বদলে দিতে পারে, তাঁদের ঠেলে দিতে পারে অন্য শিবিরে। উপরের হিসেব অনুসারে বার দুয়েক ‘কৌশল’ করে দ্বিতীয় পছন্দের দলকে ভোট দিলে, মোটামুটি দুই দলকেই সমান পছন্দ করতে শুরু করতে পারেন ট্যাকটিক্যাল ভোটার। আর সে ক্ষেত্রে এই উৎসর্গীকৃত ভোটারদের আধাআধিই কিন্তু বেহাত। এটা যে হেতু গড় হিসেব, এমনকি এক বার কৌশলী ভোট দিলেও বেশ কিছু ভোটার পাকাপাকি ভাবে বদলাতে পারেন রাজনৈতিক আনুগত্য। অঙ্ক করে দেখেছি, ব্রিটেনের প্রেক্ষিতে সেই সংখ্যাটা হয়তো খুব বেশি না-ও হতে পারে। বড়জোর দশ জনের এক জন। অবশ্য দীর্ঘ কাল ধরে কৌশলী ভোট চললে তার প্রভাব কী রকম, সে নিয়ে কোনও গবেষণা চোখে পড়েনি এখনও।

ব্রিটেনের হিসেব পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে মিলবে, দাবি করা মুশকিল। দু’জায়গার আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিস্তর পার্থক্য। তাই ২০১৯-এর পশ্চিমবঙ্গের কৌশলী বাম-ভোটাররা সবাই ভবিষ্যতে আবার বামেদের পক্ষে ‘ডাকিলেই হাজির’ হয়ে যাবেন, এমন দাবি কেউ করলেও তাকে নস্যাৎ করার মতো তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। উল্টোটাও অবশ্য নেই। তবু, কেউ ইচ্ছে করলে বোলস্টাড-ডিনাস-রিয়েরার গবেষণার ফলকে ট্যাকটিক্যাল ভোটারদের রাজনৈতিক আচরণের মোটামুটি প্যাটার্ন হিসেবে ধরে নিতেও পারেন। দেশভেদে, সময়ভেদে গড় নম্বর বা নম্বর বৃদ্ধির সংখ্যাগুলো হয়তো বদলাবে খানিকটা।

আবার, পাঁচ বছরের মধ্যে মোটামুটি ১৫% নতুন ভোটার আসে। বামেরা যখন কৌশলী ভোট দিয়ে ভোট-শতাংশে মোটামুটি নিঃস্ব, কী হবে এই নতুন ভোটারদের রাজনৈতিক চেতনা? ট্যাকটিক্যাল ভোটের এই দিক নিয়ে কোনও তাত্ত্বিক আলোচনা কিন্তু খুঁজে পাইনি কোথাও।

তাই আজ বামেরা যদি দখিন দুয়ার খুলে দিয়েই থাকেন, তাঁদের চৌকাঠ-ডিঙোনো ভোটারদের কত জন ভবিষ্যতে আবার ঘরে ফিরবেন, এই রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের প্রশ্নটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অদূর ভবিষ্যতের বড় জিজ্ঞাসা। এর পরিমাপই বা কী ভাবে হবে, সেটাও জটিল গবেষণার বিষয়বস্তু। ব্রিটেনের প্রেক্ষিতে স্টাডিটা সেই দিশায় একটা ইঙ্গিত হলেও হতে পারে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPM BJP Lok Sabha Election 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE