ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বুধবার অপরাহ্ণে তীব্র হিংসার দৃশ্যাবলি সংবলিত এক ভিডিয়ো চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মতে, সেগুলি উত্তর চব্বিশ পরগনার কিছু এলাকা হইতে সংগৃহীত। শ্রীযুক্ত ঘোষ ও তাঁহার সতীর্থদের অভিযোগ, এই দৃশ্যগুলি সংবাদের বাহিরে রাখা হইতেছে, ফলে সত্য সমাবৃত থাকিতেছে। তাঁহারা সত্যকে অনাবৃত করিতে চাহেন, অতএব সাংবাদিকদের জন্য এই প্রদর্শনী। আপাতশ্রবণে মনে হইতে পারে, রাজ্যের অন্যতম বিরোধী দল হিসাবে বিজেপি সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ, সেই দায় মিটাইতে চিত্রগুলি সংগ্রহ করিয়াছে। প্রদর্শিত চিত্রগুলি কতখানি সত্য, তাহা লইয়া সংশয়ের অবকাশ থাকিতেই পারে— ভিডিয়ো চিত্র ‘নির্মাণ’-এর বহু দৃষ্টান্ত এ কালে বহুলপরিচিত। কিন্তু সেই সংশয় আপাতত উহ্য থাকুক। রাজ্য বিজেপির এই উদ্যোগে নিহিত আছে আরও একটি অভিযোগ: সংবাদমাধ্যম এই সকল হিংসা ও হিংস্রতার খবর এবং ছবি গোপন করে। লক্ষণীয়, তাঁহাদের দলীয় বৃত্তের বাহিরে নাগরিক সমাজের একাংশ এই অভিযোগে কণ্ঠ মিলাইয়া থাকেন। দশচক্রে অভিযোগের ভার বাড়ে।
দশচক্র সুস্থ বুদ্ধিকে হরণ করে। কাণ্ডজ্ঞান বলে, একটি অস্থির সমাজে, বিশেষত অশান্ত সময়ে জনপরিসরে কী বলা হইবে, কী দেখানো হইবে, তাহার উপর সতর্ক নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। সেই নিয়ন্ত্রণ সরকারকে কায়েম করিতে না হইলেই মঙ্গল, কারণ সরকারি লাগাম একটি মুক্ত স্বাধীন সমাজের আদর্শের পরিপন্থী। সমাজ নিজেই যদি আত্মসংযম অনুশীলন করে, তাহা সর্ব অর্থেই শুভ। সেই প্রেক্ষিতে দেখিলে, হিংস্র তাণ্ডবের দৃশ্য প্রচারের সুযোগ থাকিলেও সেই সুযোগ ব্যবহার না করাই সুবিবেচনার কাজ, বিশেষত সেই দৃশ্যে যদি গোষ্ঠী-সংঘাতের প্রকাশ ঘটিয়া থাকে। হিংসার গর্ভে থাকে প্রতিহিংসা, একটি গোষ্ঠীর হিংস্র আচরণের বিবরণ বা চিত্র অন্য গোষ্ঠীকে অনুরূপ আচরণে প্রবৃত্ত হইবার প্রেরণা দিতে পারে। ভারতের নাগরিকরা এই ভয়াবহ দুষ্টচক্রের লীলা বিস্তর দেখিয়াছেন, ইহার তাড়নায় বহু বার বহু মানুষের বহু সর্বনাশ হইয়াছে। স্বভাবতই যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক এই বিষয়ে সতর্ক থাকিবেন, থাকিতে বলিবেন।
দিলীপ ঘোষ তথা তাঁহার দলটির ঘটে কয় ছটাক শুভবুদ্ধি আছে, সেই খবর তাঁহারাই জানেন। কিন্তু যে ভাবে উদ্বেগজনক অশান্তির মধ্যে দাঁড়াইয়া হিংসার সচিত্র ‘প্রমাণ’ দেখাইতে তাঁহারা ব্যগ্র হইয়াছেন, তাহাতে অন্তত সেই শুভবুদ্ধির কোনও প্রতিফলন নাই। একটি রাজনৈতিক দল ও তাহার নেতৃত্বের আচরণে যে দায়িত্ববোধ প্রত্যাশিত, এই উদ্যোগ তাহার বিপরীত মেরুতে দাঁড়াইয়া আছে। বস্তুত, হিংসার সংশ্লিষ্ট চিত্রাবলি ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া যোগে সর্বত্রগামী, যাঁহাদের সে-সকল দৃশ্য দেখিবার, তাঁহারা দিলীপবাবুদের সাহায্য ছাড়াই দেখিয়া লইয়াছেন। তাহার পরেও সত্য দর্শাইবার এই তৎপরতা সন্দেহ জাগাইতেই পারে— ইহার পিছনে অন্য কোনও দুরভিসন্ধি নাই তো? দুষ্কর্ম যে বা যাহারাই করুক, শাস্তি বিধেয়। কিন্তু তাহার জন্য ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’ ধ্বনি তুলিয়া ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয় খুঁড়িবার প্রয়োজন নাই, তাহাদের পরিচিতি হিসাবে ‘দুষ্কৃতী’ই যথেষ্ট। পশ্চিমবঙ্গ বিপন্ন। বিপদ বাড়াইবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy