রোগীর মৃত্যু কি তাহার আত্মীয়-পরিজনকে হাসপাতালে তাণ্ডবের ছাড়পত্র দেয়? ঢাকুরিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গি-আক্রান্ত এক তরুণীর মৃত্যুর পর ভাঙচুর হইল। এমন ঘটনার বিরাম নাই। চিকিৎসা কেন্দ্রে কর্তব্যরত ডাক্তার ও কর্মীদের হেনস্থা, মারধর, সম্পত্তি ভাঙচুর, প্রায় নিত্যকর্মপদ্ধতি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। দুষ্কৃতীদের প্রত্যাশা, মৃতের প্রতি সমবেদনার প্রভাবে তাহাদের সকল দৌরাত্ম্যকে ক্ষমাসুন্দর চক্ষে দেখিবে পুলিশ-প্রশাসন। যদি বা ভাঙচুর, মারধরের অপরাধে পুলিশ গ্রেফতার করে, শাস্তি হইবে সামান্য। অন্য দিকে, অনেক ক্ষেত্রেই গোলযোগ সৃষ্টি করিতে পারিলে হাসপাতালের খরচ কমিবার সম্ভাবনা থাকে, যাহা গোলযোগ সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগায়। গত কয়েক বৎসর ধরিয়াই এই ঘটনাক্রম নিয়মিত চলিতেছে। তবে সম্প্রতি তাহা পুষ্টি লাভ করিয়াছে। চিকিৎসাকে স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ করিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেসরকারি হাসপাতালের সমালোচনা করিয়াছিলেন। তাহাকে হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের হেনস্থার রাজনৈতিক অনুমোদন বলিয়া ধরিয়া লইয়াছে এক শ্রেণির লোক। রোগীর মৃত্যু হইলেই তাহারা ‘চিকিৎসায় গাফিলতি’ বলিয়া গলা ফাটাইতেছে, বিল ধরাইলেই তাহা ‘হাসপাতালের দুর্নীতি’ বলিয়া ভাঙচুর করিতেছে। বহু ক্ষেত্রে এই তাণ্ডব শোকার্ত স্বজনদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ নহে, পরিকল্পিত ও সংগঠিত অপরাধ। কলিকাতায় এক ব্যক্তি কিছু দিন পূর্বে গ্রেফতার হইয়াছেন, যিনি বেসরকারি হাসপাতালকে হুমকি দিয়া বিল কমাইবার বিনিময়ে রোগীর আত্মীয়দের নিকট ‘কমিশন’ লইবার কারবার ফাঁদিয়া বসিয়াছিলেন।
ঢাকুরিয়ার বেসরকারি হাসপাতালে সাম্প্রতিক আক্রমণেও স্পষ্ট যে, সময় লইয়া, লোক জোগাড় করিয়া, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া হাসপাতালে তাণ্ডব করা হইয়াছে। প্রত্যাশা মতোই বিল বাড়াইবার অভিযোগ তোলা হইয়াছে পরিবারের পক্ষ হইতে। ইহাও লক্ষণীয় যে, রোগীর আত্মীয়েরা অভিযোগ লইয়া চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহিত আলোচনায় গিয়াছিলেন, তাহাতে ফল না পাইয়া ক্ষিপ্ত হইয়াছেন— এমন কোনও ইঙ্গিত মেলে নাই। এই ধরনের ঘটনাগুলি লক্ষ করিলে বুঝা যায়, ভীতিপ্রদর্শন করিয়া বিলের টাকা মকুব করিবার, বা ‘ক্ষতিপূরণ’ বাবদ টাকা আদায় করিবার চেষ্টাই প্রবল। বহু চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তারা সম্মানহানি ও হয়রানি হইতে বাঁচিতে পুলিশের নিকট অভিযোগ না করিয়া অন্যায় দাবি মানিয়া লন। তাহাতেই এই দুষ্কৃতীরা সাহসী হইয়া উঠিতেছে।
অতএব এই ধরনের ঘটনাকে সংগঠিত অপরাধ বলিয়াই দেখিতে হইবে, এবং কঠোর শাস্তি দিতে হইবে। সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থায় যে গলদ আছে, তাহা কেহ অস্বীকার করিবে না। অতিরিক্ত, অকারণ ব্যয়, রোগীর প্রতি অবহেলা, অপচিকিৎসা, এমন নানা সমস্যার সত্যতা লইয়া সন্দেহের অবকাশ নাই। কিন্তু তাহার প্রতিকারের নির্দিষ্ট উপায় আছে। সেই পদ্ধতিকে আরও কার্যকর করিবার জন্য রাজ্য সরকার সম্প্রতি নানা ব্যবস্থা লইয়াছে। সেই সকল ব্যবস্থা কতটা লাভজনক হইতেছে, তাহার নিয়মিত মূল্যায়ন প্রয়োজন। কিন্তু হাসপাতালে ভাঙচুর করিয়া, চিকিৎসকদের ‘শিক্ষা’ দিয়া যে রোগীর স্বার্থ সুরক্ষিত হইবে না, হাসপাতালের দায়বদ্ধতা বাড়িবে না, তাহাও স্পষ্ট হইয়াছে। ইহাতে কেবল পরস্পর সন্দেহ ও অনাস্থাই বাড়িতেছে। মৃতপ্রায় রোগীকে যদি হাসপাতাল ‘ঝুঁকি’ বলিয়া মনে করে, তাহাকে ভর্তি করিতে রাজি না হয়, তাহা হইলে রোগীর প্রাণের আশঙ্কা বাড়িবে বই কমিবে না। হাসপাতালে যাহারা ভাঙচুর করে তাহারা অপরাধী। প্রকৃত অর্থে সমাজবিরোধীও বটে। সহানুভূতি তাহাদের প্রাপ্য নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy