Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ডাইনি অপবাদে নির্যাতন আসলে গ্রামীণ হাতিয়ার

২০১৫ সালে ভারতে ডাইন বা ডাইনি সন্দেহে খুন হয়েছেন ১৩৫ জন। তাঁদের মধ্য দু’জন এ রাজ্যের।  কিন্তু এই ২০১৯ সালেও পশ্চিমবঙ্গের মতো যে সব রাজ্যে ডাইনি-প্রথা বিরোধী আইন নেই। কিন্তু কেন? প্রশ্ন তুললেন শ্যামল মণ্ডল২০১৫ সালে ভারতে ডাইন বা ডাইনি সন্দেহে খুন হয়েছেন ১৩৫ জন। তাঁদের মধ্য দু’জন এ রাজ্যের।  কিন্তু এই ২০১৯ সালেও পশ্চিমবঙ্গের মতো যে সব রাজ্যে ডাইনি-প্রথা বিরোধী আইন নেই। কিন্তু কেন? প্রশ্ন তুললেন শ্যামল মণ্ডল

গ্রামে সচেতনতা প্রচার পুলিশের। ছবি: সঙ্গীত নাগ

গ্রামে সচেতনতা প্রচার পুলিশের। ছবি: সঙ্গীত নাগ

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৮
Share: Save:

‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে ভারতে ডাইন বা ডাইনি সন্দেহে খুন হয়েছেন ১৩৫ জন। তাঁদের মধ্য দু’জন এ রাজ্যের। বাংলার গ্রাম সমাজে আজও ডাইনি সম্পর্কে বিশ্বাস প্রবল। রাজ্যে এখনও ডাইনি বা ডাইন অপবাদে নারী-পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। কিন্তু এই ২০১৯ সালেও পশ্চিমবঙ্গের মতো যে সব রাজ্যে ডাইনি-প্রথা বিরোধী আইন নেই, সেখানে ডাইনি নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঠিকঠাক নথিভুক্ত করা হয় না।

ডাইনি-প্রথার মতো কুসংস্কারে বিশ্বাসীদের মতে, কোনও ব্যক্তি অপদেবতা বা ভূতের পুজো করে অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন করে ডাইন বা ডাইনি হয়। ডাইনি সেই অলৌকিক ক্ষমতার জোরে কোনও মানুষের ভিতরের সত্ত্বা ‘খেয়ে’ নিতে পারে। যার জেরে সেই মানুষটি অসুস্থ হয়ে পড়ে, এমনকি, তাঁর মৃত্যুও হতে পারে। ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতার জেরেই নাকি পশু-পাখি বা গাছ মারা যায়, ফসল নষ্ট হয়।

ডাইনি-প্রথা তথা বিশ্বাসের মধ্যে ওঝা, গুণিন বা জানগুরুরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তারা কোনও ঘটনার কারণ হিসেবে ডাইনির ‘কুনজর’কে দায়ী করে। পরে ‘চিহ্নিত’ করে ‘ডাইনি’কেও। তার পরে অনেক ক্ষেত্রেই, গ্রামের মোড়ল-মাতব্বরেরা ‘ডাইনি’ বলে সাব্যস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করে।

জরিমানা দিতে গিয়ে অনেককে ভিটে-মাটি বিক্রি করে ঘরছাড়া হতে হয়। এই টাকায় গ্রামের মানুষের একাংশ ভোজ খায়, ফূর্তি করে। জরিমানা অনাদায়ে নির্যাতন। ডাইনি সাব্যস্ত ব্যক্তিদের লঙ্কা পোড়ার ধোঁয়া দেওয়া হয়, ঝাঁটা ও জুতো দিয়ে মারা হয়, শূয়োর ও মানুষের বর্জ্য-সহ নানা অখাদ্যকুখাদ্য খাওয়ানো হয়। জরিমানার টাকা না দিলে তথাকথিত ‘ডাইনি’র পরিবারকে একঘরে করা হয় বা গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে হত্যাও করা হয় তাঁদের। সমাজকর্মীদের একটি সূত্র জানাচ্ছে, গ্রাম বাংলায় ‘ডাইনি’ চিহ্নিত করার জন্য ক্ষেত্র বিশেষে বহু টাকা লাভ করেন মাতব্বরেরা।

ডাইন অপবাদে পুরুষদের নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটলেও নারীদের হত্যা করার ঘটনা বেশি। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ডাইনি অপবাদ সংক্রান্ত ৫০টি ঘটনায় ৫৭ জন নারী-পুরুষকে ডাইনি সাব্যস্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে ৪৫ জন নারী এবং ১২ জন পুরুষ। দেখা গিয়েছে, আট থেকে ৮০ বছরের মধ্যে যে কোনও বয়সের মানুষই এই কুসংস্কারের শিকার হতে পারেন।

সাধারণত গ্রাম সমাজে কোনও ব্যক্তি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলে বা কোনও দুর্ঘটনায় জখম হলে ‘ডাইনির কারসাজি’কে দায়ী করার প্রবণতা দেখা দেয় তাঁর পরিজনেদের মধ্যে। তবে একটু তলিয়ে দেখলে এর পিছনের রাজনৈতিক চিত্রটা ধরা পড়ে। ডাইনি-প্রথায় বিশ্বাস করার পিছনে গ্রাম সমাজের চিরাচরিত অন্ধবিশ্বাস, আধুনিক চিকিৎসা লাভের প্রতিবন্ধকতা অবশ্যই রয়েছে। তবে কিছু চালাক এবং সুবিধাবাদী শ্রেণির মানুষের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। এই ব্যক্তিরা কোনও মানুষকে সামাজিক ভাবে হেয় করার জন্য ডাইনি সাব্যস্ত করে থাকেন। ডাইনি সাব্যস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে জরিমানা বাবদ অর্থ, জমি, সম্পত্তি জোর করে আদায় করা হয়। এমনকি, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তিকে শায়েস্তা করার জন্যও ডাইনি অপবাদ দেওয়া হয়ে থাকে।

আবার সমাজে নারীদের দমিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় এই ডাইনি-প্রথা। পিছিয়ে পড়া বর্গের পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষ তাঁদের অপছন্দের নারীকে, ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ডাইনি অপবাদে নির্যাতন আসলে নারী নির্যাতনের গ্রামীণ হাতিয়ার।

ডাইনি-প্রথা গ্রামীণ সমাজে নারীদের উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। দ্বাদশ শতাব্দীতে গোবর্ধন আচার্য তাঁর ‘আর্যসপ্তশতী’ গ্রন্থের একটি শ্লোকে উল্লেখ করেছেন, ‘সখি ধীরে পা ফেলে চল। তোমার উদ্ধত আচরণ দেখে পল্লীপতি ডাকিনী বলে দণ্ডবিধান করতে পারেন’। বাংলার অনেক গ্রামে এই চিত্র এখনও বাস্তব।

পারিবারিক হিংসায় অপছন্দের মানুষকে ডাইনি অপবাদ দেওয়াও সাধারণ ব্যাপার। ষোড়শ শতকে কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী চণ্ডীমণ্ডল কাব্যে ধনপতি সদাগরের পত্নী লহনা তাঁর সতীন খুল্লনা সম্পর্কে কানভারী করার জন্য বলছেন, ‘তোমার মোহিনীবালা/ শিখয়ে ডাইনিকলা/ নিত্য পূজে ডাকিনী দেবতা’।

সমাজের উন্নয়নের জন্য এই ডাইনি-প্রথার অবসান ঘটানো দরকার। এ জন্য স্কুলপাঠ্যে ডাইনি-প্রথা বিরোধী পাঠের প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বইয়ের পাঠ্য বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সহায়ক হয়েছে। একই ভাবে ডাইনি-প্রথা বিরোধী পাঠ সংযুক্ত হলে এই প্রথা প্রতিরোধেও তা সহায়ক হবে বলে আমার আশা। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে ২০১৩ সালে ডাইনি-প্রথা বিরোধী একটি তথ্যচিত্র ‘মানহুঁশ মের না’ তৈরি করা হয়েছে।

সর্বোপরি পশ্চিমবঙ্গে ডাইনি-প্রথা বিরোধী কঠোর আইন চাই। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই প্রথা বিরোধী আইন আছে। তবে শুধু আইন থাকলেই চলবে না, ডাইনি-প্রথা টিঁকে থাকার কারণগুলিকে সদর্থক ভাবে নির্মূল করতে হবে।

ঝাড়খণ্ডে ডাইনি-প্রথা বিরোধী আইন থাকলেও সে রাজ্যেই ডাইনি অপবাদে হত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। ২০১৫ সালে ঝাড়খণ্ডে ৩২ জন ডাইনি অপবাদে খুন হয়েছেন। এখনও পর্যন্ত যে সব রাজ্যে ডাইনি-প্রথা বিরোধী আইন রয়েছে, তাদের মধ্যে অসমের আইন সবচেয়ে বেশি কঠোর। তবে সবচেয়ে ভাল হয় ভারত সরকারের উদ্যোগে ডাইনি-প্রথা বিরোধী আইন পাশ হলে। তা হলে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের ডাইনি-প্রথা বিরোধী আইন থাকার পরিবর্তে, সারা দেশে এক আইন চালু হবে। এক কালে এই বঙ্গেই সতীদাহ প্রথা আইন করে নিষিদ্ধ হয়েছিল। তা হলে ডাইনি অপবাদ দেওয়ার এই কুপ্রথার বিলুপ্তি সম্ভব নয় কেন?

লেখক পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Torture Witch
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE