Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
আন্তর্জাতিকতার প্রয়োজন যখন সবচেয়ে বেশি ছিল

ব্লু হোয়েল ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

ট্রাম্পের ভাষণ শুনে শিহরিত হওয়ার মধ্যে তাই কোনও খবর নেই। খবর অন্যত্র। সেই খবর জানার জন্য প্রথমে খেয়াল করা যাক রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ-এর প্রতিক্রিয়া।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:২৯
Share: Save:

রাষ্ট্রপুঞ্জে তাঁর প্রথম বক্তৃতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানকে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ বলেছেন, কিম জং আন বেশি ঝামেলা করলে ‘গোটা উত্তর কোরিয়াকে ধ্বংস করে দেব’ বলে হুমকি দিয়েছেন, এ-সব শুনে দুনিয়া শিহরিত। এত শিহরনের কোনও কারণ অবশ্য ছিল না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে এমনটাই প্রত্যাশিত। তা ছাড়া, মার্কিন প্রেসিডেন্টের অসংযত উচ্চারণ এই প্রথম নয়। জর্জ ডব্লিউ বুশ যখন ইরান-উত্তর কোরিয়া-ইরাককে ‘অ্যাক্সিস অব ইভল’ নাম দেন, সেটা ভদ্রতার পরিচয় ছিল না। ৯/১১-র পরে আমেরিকার আফগানিস্তান অভিযানে সহযোগিতা না করলে পাকিস্তানকে প্রস্তরযুগে ফিরিয়ে দেওয়ার হুমকিও তাঁরই। আর, কথার চেয়ে কাজ যদি বেশি বাঙ্ময় হয়, তবে তো হিরোশিমা থেকে ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান থেকে ইরাক— ওয়াশিংটনের কীর্তিকাহিনি একেবারে বোমায় বাঁধানো। বস্তুত, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখেশুনে যদি উৎকট লাগে, তবে মনে রাখতে হবে, তিনি আকাশ থেকে পড়েননি, ধরাকে-সরা-জ্ঞান-করা এক বিপুল মহাশক্তির উৎকট দুনিয়াদারির ইতিহাস থেকে উঠে এসেছেন। নির্বাচন নামক মহান গণতান্ত্রিক পথটি ধরেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বাভাবিক নন, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু যে দেশের বহুসংখ্যক মানুষ তাঁকে ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট করেন, সেই দেশটাকেও স্বাভাবিক বলা চলে কি? ব্লু হোয়েল ভয়ংকর, কিন্তু কেন এত মানুষ এ খেলা খেলছে, সেই প্রশ্ন আরও ভয়ংকর।

ট্রাম্পের ভাষণ শুনে শিহরিত হওয়ার মধ্যে তাই কোনও খবর নেই। খবর অন্যত্র। সেই খবর জানার জন্য প্রথমে খেয়াল করা যাক রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ-এর প্রতিক্রিয়া। তিনি বলেছেন, ‘‘আমেরিকা অন্য দেশের ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেবে না, ট্রাম্পের এই বার্তাটি খুব প্রশংসনীয়। কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে এমন কথা বহু দিন শোনা যায়নি।’’ ভ্লাদিমির পুতিনের বিদেশমন্ত্রীর প্রশংসা অহেতুক নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপুঞ্জে দাঁড়িয়ে একটি ধারণার তুমুল জয়গান করেছেন। সেটি হল ‘সভরিনটি’। নিদেনপক্ষে পঁচিশ বার নানা ভাবে সার্বভৌমত্বের উল্লেখ আছে তাঁর বক্তৃতায়। একটি বাক্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য: ‘‘শক্তিশালী সার্বভৌম রাষ্ট্রেরা বিভিন্ন দেশকে তাদের নিজের নিজের মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি নিয়ে কেবল সহাবস্থান করতে দেয় না, পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে পাশাপাশি কাজ করতে দেয়।’’

আপাতমধুর এই বাক্যটিতে নিহিত রয়েছে এক গূঢ় বার্তা। কোনও রাষ্ট্র তার নিজের সীমানার মধ্যে কী করছে না করছে, ওয়াশিংটন সে বিষয়ে মাথা ঘামাবে না। এই বার্তা বিশেষত ‘শক্তিশালী’ রাষ্ট্রগুলিকে উদ্দেশ্য করে। শি চিনফিং নিজের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন কি না, তা নিয়ে ট্রাম্পের কোনও মাথাব্যথা নেই। বস্তুত, ভ্লাদিমির পুতিনেরা স্বদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আঞ্চলিক পরিসরেও, যথা ইউক্রেনে, দাপট বাড়াতে পারেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্য দিকে তাকিয়ে থাকবে, বড়জোর বলবে, ‘অ্যাই, কী হচ্ছে!’ রাষ্ট্রপুঞ্জের ভাষণে সাউথ চায়না সি এবং ইউক্রেন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক তা-ই করেছেন। এই ভাষণ নিয়ে চিন কার্যত নীরব থাকবে, রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী ট্রাম্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেন, সেটাই স্বাভাবিক।

সার্বভৌমত্বের এই জয়ধ্বনির পিছনে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্রের কোনও আদর্শ খুঁজে লাভ নেই। এ হল নির্ভেজাল ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’-এর বুদ্ধি, পোশাকি পরিভাষায় যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্রানজ্যাকশনাল’ অর্থাৎ লেনদেনসর্বস্ব রাষ্ট্রনীতি। ডোনাল্ড ট্রাম্প লাগাতার বলে আসছেন, প্রত্যেকটা দেশকে নিজের নিজের নিরাপত্তার দায় নিতে হবে, রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনে সবাইকে যথেষ্ট টাকা দিতে হবে, আমেরিকার পয়সায় ও-সব আর চলবে না। অর্থাৎ, যে যার খরচ দাও, জগৎসভা চালু থাকবে, দেখাসাক্ষাৎ হবে, আন্তর্জাতিকতা দীর্ঘজীবী হবে, না হলে— বিদায়। আশির দশকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ঘোষণা করেছিলেন, ব্যক্তি সত্য, সমাজ মিথ্যা, ব্যক্তি-নাগরিকরা নিজের নিজের স্বার্থে পরস্পর লেনদেনের সম্পর্ক গড়তে চায় গড়বে, সমাজ বলে আলাদা কিছু নেই, থাকার দরকার নেই, থাকা উচিত নয়। এই মহান নীতিকেই ট্রাম্প বিশ্বপরিসরে প্রসারিত করতে চান। এবং রাষ্ট্রপুঞ্জে নিজের প্রথম ভাষণে সেটাই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।

তবে কি তিনি আমেরিকাকে ফিরিয়ে দিতে চান তার সেই ঐতিহাসিক ‘আইসোলেশনিস্ট’ অবস্থানে, গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে পর পর দুটি মহাযুদ্ধ তাকে যে বিচ্ছিন্ন একাকিত্ব বিসর্জন দিতে বাধ্য করেছিল এবং তার পরে দুনিয়াদারির অর্থনৈতিক ও সামরিক মুনাফা তুলতে যে বিচ্ছিন্নতার বিপরীত মেরুতে সরে গিয়ে এই গ্রহ জুড়ে আধিপত্য বিস্তারে অতিমাত্রায় তৎপর করে তুলেছিল? না, তা আর সম্ভব নয়। পৃথিবী বদলে গেছে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার কোনও উপায় আর নেই। সেটা ডোনাল্ড ট্রাম্পও জানেন।

আর সেখানেই তাঁর ‘যার যার তার তার’ নীতির মৌলিক এবং আত্মঘাতী দুর্বলতা। বারাক ওবামা অনেক কষ্টে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পথে ইরানের সঙ্গে বিরোধ নিরসনের একটা ভিত তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন, কট্টরপন্থীদের নির্বাচনে হারিয়ে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের পদে অনেক বেশি উদার হাসান রুহানিকে ফিরিয়ে এনে ইরানের মানুষ সেই ভিতটাকে শক্ত করেছিলেন। ট্রাম্পের কাজ ছিল তার ওপর কূটনীতির সৌধ নির্মাণ করা, যেখানে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি সে দেশে গণতন্ত্রের পথ আরও প্রশস্ত হতে পারে। এবং তাঁর কাজ ছিল চিনের সাহায্যে উত্তর কোরিয়াকেও ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। একটা যথার্থ, ইতিবাচক আন্তর্জাতিকতা ছাড়া এই কঠিন কাজগুলো সম্ভব নয়। বস্তুত, পরমাণু অস্ত্রের প্রসার থেকে জলবায়ু পরিবর্তন— কোনও সমস্যাই আজ আর একা একা সমাধান করা যাবে না। আন্তর্জাতিকতা একুশ শতকে যতটা অপরিহার্য, আগে কখনও ততটা ছিল না।

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে আসল বিপদ এখানেই। বিশ্ব রাজনীতির বাস্তব যা চায়, তাঁর চিন্তাভাবনা তার সম্পূর্ণ উল্টো। আন্তর্জাতিকতা তাঁর ধাতে নেই। অতএব ইরান বা উত্তর কোরিয়াকে বশে আনতে তাঁর একটাই নীতি: বোমা মেরে উড়িয়ে দাও। এবং, নির্মম বাস্তব এই যে, তাঁর এই ভাবনায় তাঁর দেশের বহু নাগরিকের জোরদার সমর্থন আছে। রাষ্ট্রপুঞ্জে দাঁড়িয়েও তিনি আসলে সেই স্বদেশি সমর্থকদের উদ্দেশেই ভাষণ দিয়েছেন। তাঁর বিদেশ নীতি স্বদেশের রাজনীতির খুঁটিতে বাঁধা। সেই রাজনীতির তাড়নায় তিনি যে সত্যিই তেহরান বা পিয়ংইয়াংয়ের প্রতিস্পর্ধীদের বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে চাইবেন না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এবং যদি সে আশঙ্কা সত্য হয়, তবে বুঝতে হবে, ব্লু হোয়েল এখনও বাকি আছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE