পিতাকে খুন করিয়া সিংহাসন লাভ করিবার ইচ্ছা কেবল ঐতিহাসিক গল্পেই এ যাবৎ শুনা গিয়াছে। এ কালে সেই প্রথার তেমন চল নাই। তাহার একটি কারণ, সেই রাজাও নাই, সে সিংহাসনও নাই। কিন্তু রাজত্ব বা সিংহাসন না থাকিলেও একটি বস্তু আছে, আছে তাহার বিপুল মহিমাও। সেই বস্তুটির নাম অর্থ। তাহার প্রবল টানে প্রতিনিয়ত রকমারি অনাচার ঘটিয়া চলিয়াছে। তবে কখনও কখনও এক একটি অনাচারের সংবাদ আজও, এই অন্ধকার সময়েও, স্তম্ভিত করিয়া দেয়। সম্প্রতি ব্যারাকপুরের এক বাসিন্দাকে খুন করিবার চেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত হইয়াছে তাঁহার বড় ছেলে। অভিযোগ— ব্যবসায় বারংবার লোকসানের ফলে সে বাবার নিকট টাকা চাহিয়াছিল, বাবা টাকা দিতে অসম্মত হইলে, ছেলে তাঁহাকে খুন করিয়া সম্পত্তি হাতাইয়া লওয়ার পরিকল্পনা করে। এই উদ্দেশ্যে সে দুই বন্ধুকে ‘সুপারি’ দিয়াছিল অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে বাবাকে খুন করাইবার জন্য ভাড়া করিয়াছিল। ওই দুই বন্ধু সেই মহান কর্মটি সম্পাদনের চেষ্টায় ভদ্রলোককে গুলিও করে, বরাতজোরে তিনি বাঁচিয়া গিয়াছেন। যুগপৎ বিস্মিত ও আতঙ্কিত হইবার মতো কাণ্ডই বটে। কিছু টাকার জন্য নিজের বাবাকে খুন করিতে উদ্যত হওয়া, আর যাহাই হউক, স্বাভাবিক নহে। প্রশ্ন ওঠে, পুত্রটি কি মানসিক ভাবে অসুস্থ? কিন্তু তাহার আচরণ, বিশেষত পুলিশের নিকট তাহার জবানবন্দি কিংবা তাহার সুপারি দিয়া বাবাকে খুন করাইবার পরিকল্পনা দেখিয়া-শুনিয়া তেমন তো মনে হয় না। তাহা হইলে?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে গিয়া সংশয় হয়, সমাজ কি তবে ক্রমশ এমন একটি অবস্থায় পৌঁছাইয়াছে, যেখানে মানবিক সম্পর্কের স্বাভাবিক লক্ষণগুলি দ্রুত বিলীয়মান, লক্ষ্য কেবল একটিই: কী করিয়া আরও অর্থ সংগ্রহ করা যায়? মানিতে কষ্ট হইলেও উত্তরটি ‘হ্যাঁ’। সমাজ এখন যে-দিকে হাঁটিতেছে, সেখানে জীবনের প্রতিটি বিষয় এবং প্রতিটি মুহূর্তকে, নিতান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের, এমনকী বন্ধুত্ব বা দাম্পত্যের মতো সম্পর্কগুলির দৈনন্দিন যাপনকেও বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করিতেছে বাজারি লেনদেন। অর্থই স্থির করিতেছে সম্পর্কের গভীরতা। হয়তো এমনটি হইবারই ছিল। কয়েক বৎসর ধরিয়াই বিজ্ঞাপনে, বিনোদনে, সামাজিক মাধ্যমে মহা আড়ম্বরে চলিতেছে প্রাচুর্যের জয়গান। হঠাৎ দেখিলে বোধ হয় ভারতীয় অর্থনীতিতে যেন সমৃদ্ধির বিস্ফোরণ ঘটিয়াছে। রাতারাতি দারিদ্র শব্দটিই যেন অভিধান হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে। বাস্তব সম্পূর্ণ অন্য কথা বলিলেও তাহা শুনিতেছে কে? এই কল্পবাস্তবের প্রভাব পড়িয়াছে সমাজের এক বড় অংশের মনে। ধারণা জন্মিয়ােছ— ‘উন্নততর’ জীবন করায়ত্ত না হইলে যেন জন্মই বৃথা, সৎ পথে তাহা দখল করিতে না পরিলে অসৎ পথই সই। প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট মানের জীবনযাপন করিতেই হইবে, সাধ্যের প্রসঙ্গটিই যেন অবান্তর। এই সোনার হরিণের পশ্চাতে ছুটিতে গিয়া যে একে একে মানবিকতাবোধ, বিশ্বাস, পারস্পরিক সম্পর্কের মাধুর্যের মতো জিনিসগুলি মানুষ হারাইতে বসিয়াছে, সেই দিকে কাহারও নজর নাই। এই অবক্ষয়ের সামনে দাঁড়াইয়া বাবাকে খুন করাইবার পরিকল্পনা হয়তো অচিরেই আর তত অস্বাভাবিক বোধ হইবে না। অস্বাভাবিক-এর এই স্বাভাবিকতা অর্জনই হয়তো আগামী দিনে আমাদের নিয়তি।