বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলটিকে বলা হয় হিন্দুত্ববাদী। কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শ যদি হয় মার্কসবাদী আর্থিক সাম্য তবে বিজেপির প্রধান মতাদর্শ হল হিন্দুত্ব। অনেকে বলেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদ। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের তিনটি প্রধান দাবি। ১) অযোধ্যায় রামজন্মভূমি স্থানে মন্দির নির্মাণ। ২) ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারাটিকে অবলুপ্ত করতে হবে, যেখানে কাশ্মীরের জন্য বিশেষ স্বশাসনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ৩) অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এ দেশে চালু করতে হবে। অর্থাৎ, ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইনের পৃথক পরিসর কেন থাকবে? অর্থাৎ, মুসলিম পার্সোনাল ল-কে প্রত্যাহার করে মুসলিম সমাজকেও ভারতের অভিন্ন সংবিধানের এক্তিয়ারে আনতে হবে।
তখন এনডিএ জমানা। অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী। সে সময়ে উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী এক বার আমাকে বলেছিলেন, ‘‘দলের নেতাদের আমি বার বার এটাই বলার চেষ্টা করছি যে আপাতত রামমন্দির নির্মাণ আর ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত করার মতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করা যাবে না। কারণ, এখন তো বিজেপি একা ক্ষমতায় নেই। এনডিএ, তার মানে আরও অনেক শরিক নিয়ে আমাদের সরকার গঠন হয়েছে। কিন্তু এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে তো আমরা জোরদার আন্দোলন শুরু করতেই পারি।’’ তার পর আডবাণী দু’টি হাত কচলাতে কচলাতে গোঁফের নীচে মুচকি হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘‘আরে বাবা, তিন তালাকের বিরুদ্ধে যদি আমরা সোচ্চার হই তাতে কমিউনিস্টরাও মানতে বাধ্য হবেন।’’
রাজীব গাঁধীর সময়ে শাহবানু মামলা নিয়ে কী হয়েছিল মনে আছে আপনাদের? যুগান্তকারী একটা রায় হয়েছিল এই মামলায়। সুপ্রিম কোর্ট মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের বাইরে বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলায় স্বামীকে বাধ্যতামূলক ভাবে স্ত্রীকে খোরপোষের দায়িত্ব নিতে বলে। যেহেতু এই রায় মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে স্পর্শ করে, অতএব মৌলবাদীরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয় এবং শাসক বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ভারতে ভোটে জিতে সরকার গড়তে গেলে মুসলিম ভোটের গুরুত্ব ভেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী আইন করে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অকার্যকারী করে দেন। এর ফলে বিজেপির প্রভূত রাজনৈতিক সুবিধা হয়। হিন্দি বলয়ে ধর্মীয় মেরুকরণের সুবিধে পায় বিজেপি।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাকের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে বলেছে। পার্সোনাল ল-এর বিপক্ষেই মতামত দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট সুপ্রিম কোর্টের কাজ করেছে, কিন্তু এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড। এমনকী, মুসলিম ল বোর্ডের মহিলা সদস্যরা পর্যন্ত এই ব্যক্তিগত আইনে রাষ্ট্র বা আদালতের নাক গলানোর বিরোধিতা করেছে। এ দিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী তিন তালাক প্রথার বিরোধিতা করেছেন। সমস্যা হচ্ছে, এই বিতর্ক এ দেশে এমন একটা সময়ে হচ্ছে যখন উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। ফলে সমাজবাদী পার্টি সংখ্যালঘু ভোটের জন্য আর বিজেপি হিন্দু ভোট একত্রিত করার জন্য মেরুকরণের রাজনীতি চাইছে।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
মনে রাখবেন, ১) তিন তালাক প্রথা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, এমনকী সৌদি আরবের মতো দেশে নেই। খারিজ হয়ে গিয়েছে বহু দিন আগে। ২) তিন তালাক প্রথা সম্পর্কে ইসলামের সাবেক বক্তব্য, দাম্পত্য জীবন যখন সঙ্ঘাতে পৌঁছয় হিংসা রুখতে তিন তালাক প্রথা পারস্পরিক ভাবে আলাপ-আলোচনা করে পৃথক হয়ে যাওয়ার যৌথ অধিকার। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা ইসলামের অপব্যবহার। ৩) তিন তালাক প্রথা প্রয়োগ করে কিন্তু নারীও তালাক চাইতে পারে নানা কারণে। কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারে না। এটাই ইসলাম সিদ্ধ ব্যক্তিগত আইন।
আমার মনে হয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্টরা মুসলিম ভোটের জন্য যদি এই তালাক প্রথা অবলুপ্ত করার দাবিতে চুপ থাকেন তবে এ দেশে আবার বিজেপির রাজনৈতিক লাভ হবে। এ কথা ঠিক, আচমকা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগের জন্য সমস্ত ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইন আজ চাইলাম, আর কালই অবলুপ্ত করে দিলাম তা হয় না। এই প্রক্রিয়া একমাত্র বাস্তবায়িত হতে পারে ধীরে ধীরে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে।
রামচন্দ্র গুহ সম্প্রতি এক প্রবন্ধে বলেছেন হিন্দুদের সমাজেও বহু ব্যক্তিগত আইন আছে। খাপ পঞ্চায়েত অনেক সময় মুসলিম ল বোর্ডের চেয়েও ভয়ঙ্কর। সমীক্ষা বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম মহিলা তালাকের বিরুদ্ধে, কিন্তু নির্বাচনী স্বার্থে আইন বদলানো সামাজিক ব্যাধি থেকে আমাদের মুক্ত করবে না। মানছি রামচন্দ্র গুহ-র কথা। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে আজ অরুণ জেটলি-রবিশঙ্কর- বেঙ্কাইয়া যা চাইছেন, তার বিরোধিতা করাও কিন্তু সঠিক পথ নয়।
পরের সপ্তাহে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব দার্শনিক প্লেটো ও অর্থশাস্ত্র রচয়িতা কৌটিল্যর সঙ্গে। ওঁদের দুজনকেই আমি শাহি সমাচারের মঞ্চে আসতে অনুরোধ করেছি। ওঁদের সঙ্গে আগামী সপ্তাহে শাহি সমাচারের মঞ্চে শুরু হবে এক অভিন্ন কথোপকথনের প্রক্রিয়া।
দেখা হবে বুধবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy