ইলাহাবাদের প্রতি এমন অবিচার কেন? মুঘলসরাই যদি দীনদয়াল উপাধ্যায় হইতে পারে, ইলাহাবাদের কপালে কি অন্তত মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর নামটুকু জুটিত না? বস্তুত, গুরুত্বের তুল্যমূল্য বিচারই যদি করিতে হয়, তবে যথার্থ নামটি হওয়া উচিত ছিল বিনায়ক দামোদর সাভারকর। যাঁহার প্রদর্শিত পথে মেরুকরণের রাজনীতি আজ রাস্তা, রেলস্টেশন, এমনকি শহরের নাম পাল্টাইবার বালখিল্য অত্যুৎসাহে পরিণত হইয়াছে, তাঁহাকে স্মরণ না করিলে চলে? অথবা, ইলাহাবাদ নাম পাল্টাইয়া হইতে পারিত কেশব বালিরাম হেডগেওয়াড়। কোনও ইতিবাচক কারণে ভারতের ইতিহাস যাঁহাদের স্মরণ করিবে না, একের পর এক নাম পাল্টাইয়া তাঁহাদের নাম মানুষের মনে গাঁথিয়া দেওয়ার প্রকল্পটি খাসা। এবং, ক্ষমতাসীন থাকিবার সময়ই কাজ সারিয়া রাখা বিধেয়। কারণ, যাঁহারা বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করেন, অতীতের নিয়ন্ত্রণ তাঁহাদেরই হাতে; আর অতীত যাঁহাদের দখলে, ভবিষ্যৎকে তাঁহারাই নিয়ন্ত্রণ করিবেন। কাজেই, ভবিষ্যতের স্বার্থে অকিঞ্চিৎকর অতীতকে ভারতের বর্তমানের স্কন্ধে বেতালের ন্যায় চাপাইয়া দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত। সেই কারণেই প্রশ্ন, প্রয়াগরাজ নামটি কি যথার্থ হইল? ‘নামকরণের সার্থকতা’ বিষয়ে রচনাধর্মী প্রশ্ন আসিলে দশে সাড়ে তিনের বেশি জুটিবে? বিশেষত, প্রয়াগরাজে হিন্দুত্ব আছে, সত্য, কিন্তু ভূগোল একেবারেই নাই। ইলাহাবাদ নামক শহর আর প্রয়াগ নামক গঙ্গা-যমুনার সংযোগস্থলের ভৌগোলিক দূরত্ব যে হেতু নিতান্ত অবজ্ঞাজনক নহে, একটি নামকে অন্যের ঘা়ড়ে চাপাইয়া দেওয়া গা-জোয়ারি। অবশ্য, সঙ্ঘ পরিবার চির কালই উচ্চবর্ণীয় হিন্দুত্বের ছত্রচ্ছায়ায় দলিতদের টানিবার চেষ্টার দ্বারা ইতিহাস-অস্বীকারের প্রয়াস করিয়ােছ, তুমুল দখলদারি দেখাইয়াছে। সেই দিক দিয়া দেখিলে, প্রয়াগ হইতে ইলাহাবাদ তো সওয়া ঘণ্টার পথও নহে।
নাম পাল্টাইলে, আজ না হউক পরশুর পরের দিন, ইতিহাসও বিস্মৃত হয়। ইলাহাবাদের বহুত্ববাদী ইতিহাসকে খাটো করিয়া হিন্দুত্ববাদের মাপে ধরাইয়া দেওয়ার চেষ্টাটিও অন্তত আংশিক ভাবে সফল হইবে বলিয়াই আশঙ্কা। আকবরের দুর্গ প্রতিষ্ঠা হইতে বিদ্রোহী জাহাঙ্গিরের প্রতিস্পর্ধী রাজসভা, এবং অতি অবশ্যই আনন্দ ভবন নামক একটি বাড়ির ইতিহাস— কয়েক শত বৎসরে ইলাহাবাদ শহরটির উপর যত বর্ণের পরত প়়ড়িয়াছিল, গৈরিক আস্তরণে সব ঢাকিয়া ফেলিবার চেষ্টা হইবে। এবং, সেই চেষ্টা শুধু গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থিত শহরটিতেই সীমাবদ্ধ থাকিবে, তেমন ভাবিবার প্রশ্নই উঠে না। ইতিমধ্যেই শিমলাকে শ্যামলায় পাল্টাইয়া ফেলিবার প্রস্তাব আসিয়াছে। বিহারের বখতিয়ারপুরের নাম হইতেও বখতিয়ার নামটি মুছিয়া ফেলিবার সম্ভাবনা প্রবল, অন্তত বিজেপি নেতার তেমনই দাবি। অনুমান করা চলে, কালক্রমে লখনউকে লক্ষ্মণাবতী, দিল্লিকে ইন্দ্রপ্রস্থ বানাইবার প্রস্তাবও আসিবে। কিন্তু, মুকুন্দ ঘোষের কী হইবে? যোগী আদিত্যনাথ জানেন কি না জানা নাই, তবে ইলাহাবাদের ইতিহাস ঘাঁটিতে বসিলে এই নামটির সন্ধান মিলিতে পারে। মুকুন্দ ঘোষ ছিলেন এক সাধক। কথিত আছে, এক দিন গোদুগ্ধ পান করিবার কালে তাঁহার মুখে পড়ে গরুর একটি রোম। তাহাতে সাধকের এমনই গ্লানি হয় যে তিনি নাকি আত্মঘাতী হন। পুণ্যবান পুরুষ, অথচ আত্মঘাতের দোষে দুষ্ট, ফলে লোকগাথা বলে, তাঁহার পুনর্জন্ম হইয়াছিল এক অতি ধর্মপ্রাণ মুসলমান রূপে। সেই মুসলমান পুরুষই নির্মাণ করেন ‘ইলাহাবাস’ দুর্গ, যাহাতে অক্ষয় বট ছিল, অক্ষয় কূপ ছিল, এমনকি ছিল অশোক স্তম্ভও। তাঁহার নাম সম্রাট আকবর। ইহাই ভারত। লোকসংস্কৃতি এই ভাবেই ধর্ম-বর্ণের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া দেশের বহুবর্ণ শামিয়ানাটি রচনা করিয়াছে। শহরের নাম পাল্টাইয়া কি ভারতের এই সংস্কৃতিটিকে মুছিতে পারিবেন আদিত্যনাথরা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy