Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
rose

দূরে সরিয়ে না রেখে, আত্মীকরণ দরকার

ভারতের সংস্কৃতিকেও এই সব দিনের অনুষঙ্গে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে হবে। সে জন্য দরকার সংস্কৃতির মেলবন্ধন। কেমন হয় যদি ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে দেশীয় ওডিসি, অসমের বিহু, বাংলার ছৌয়ের সম্মেলনে, আয়োজিত কোনও উৎসব বিদেশের মাটিতে মঞ্চস্থ হয়। লিখছেন দেবাশিস নাগ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ আসলে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের একটি লৌকিক উৎসব।

চলছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-এর প্রস্তুতি। ছবি: উদিত সিংহ

চলছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-এর প্রস্তুতি। ছবি: উদিত সিংহ

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:২৫
Share: Save:

গত শতকের সাতের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমার সঙ্গে ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটির প্রথম পরিচিতি। তখন বুঝিনি, বিশ্বায়নের সর্বব্যাপী প্রভাব এত তীব্র হতে পারে। যার, প্রভাবে বাংলার সংস্কৃতিরও অভিমুখ বদলে যেতে পারে। এক সময়, সরস্বতী পুজোর দিনটি ছিল বাঙালি যুবক, যুবতীদের কাছে ‘প্রেম দিবস’। তপন সিংহের ‘আপনজন’ ছবির এই দিনটির প্রেমদৃশ্য আজও অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। সেই দিনটি ছিনিয়ে নিল পশ্চিমের ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এখন বাঙালি যুবক, যুবতীদের কাছে ‘প্রেম দিবস’। এই দিনকে সফল করতে শুধু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই নয়, এগিয়ে এসেছে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও। রাজ্যের উদ্যানপালন দফতরের উদ্যোগে এ দিন ন্যায্য মূল্যে গোলাপ-সহ অন্য ফুল বিক্রি করা হচ্ছে। ভ্যালেন্টাইন্স কার্ড ও মোবাইলে শুভেচ্ছার পর শুভেচ্ছা, উপহার, পুষ্প বিনিময় আরও কত কী! ডিজিটাল দুনিয়ায় ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার ইত্যাদির দৌলতে আমরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাই। ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে যুবক যুবতীদের মধ্যেকার উন্মাদনা টের পাওয়া যায় শপিং মল, নদীর ধারে পার্কে গেলেই।

‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ আসলে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের একটি লৌকিক উৎসব। যাঁকে কেন্দ্র করে এই উৎসবের আয়োজন সেই ভ্যালেন্টাইনের কোনও ঐতিহাসিক অস্তিত্ব রয়েছে কিনা তা স্পষ্ট করে জানা যায় না। তাঁকে ঘিরে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। ক্যাথলিক খ্রিস্টিয় ট্র্যাডিশন অনুসারে গল্পটি হল, সম্রাট ক্লডিয়াসের রাজত্বকালে তৃতীয় শতকের কোনও এক দিন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন অভিযুক্ত সৈনিকদের গোপনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। তাঁদের বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। নির্যাতিত অভিযুক্তদের উদ্ধার করে তিনি খ্রিস্টিয় ঐতিহ্য বিরোধী কাজ করেছেন, এই অভিযোগে তাঁকে বন্দি করা হয় এবং বিচার শেষে ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি শহিদ হন। কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি বন্দি থাকাকালীন জুলিয়া নামে জেলারের অন্ধ কন্যাকে স্পর্শ করলে জুলিয়া দৃষ্টি ফিরে পায়। পরে তিনি জুলিয়াকে একটি পত্র পাঠান যার নীচে লেখা ছিল, ‘তোমার ভ্যালেন্টাইন’। তাঁর এই অলৌকিক ক্ষমতার জন্যই রোমের ক্যাথলিক চার্চ তাঁকে সেন্ট করে ঘোষণা করে। অনেকে মনে করেন ভ্যালেন্টাইন রোমান মিথোলজির কোনও এক জন চরিত্র। খ্রিস্টধর্ম প্রচলিত হওয়ার প্রথম দিকে অনেক শহিদকে ভ্যালেন্টাইন নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। সেখানে বেশ কয়েক জন, ভ্যালেন্টাইনের পরিচয় পাওয়া যায়। ভ্যালেন্টাইন তিনিই হন যিনি এক জন ‘সেন্ট’। বর্তমানে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে এই দিনটিতে ‘রোমান্টিক উৎসব’ পালন করে থাকে।

এই তারিখটির সঙ্গে রোমান ‘লুপারক্যালিয়া’ উৎসবের তারিখ মিলে যাওয়ায় এর সঙ্গে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন অনেক গবেষক। লুপারক্যালিয়া প্রাচীন রোমের একটি ‘লোকউৎসব’ যা লৌকিক দেবতা লুপারক্যাসের সম্মানে অনুষ্ঠিত হত। সেই সঙ্গে যাজকেরা ১৫ ফেব্রুয়ারি, কৃষি পশু ও প্রজননের দেবতা ফেনাসের উদ্দেশ্যে ছাগল, ভেড়া, প্রভৃতি পশুবলি দিতেন। তাঁদের ধারণা, এর মধ্য দিয়ে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে। একই ভাবে বাঙালি সমাজে কৃষির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং সন্তান কামনায় কার্তিক পুজোর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ‘লুপারক্যালিয়া’ উৎসবের সময় পুরুষেরা লটারির মাধ্যমে তাদের স্ত্রী সঙ্গী বেছে নিতেন। এবং পরে উৎসবের দিন পর্যন্ত তারা এক সঙ্গে, এক বছর বসবাস করতেন। এদের মধ্যে অনেকেই প্রেমে পড়ে যান এবং বিবাহ করেন। সম্ভবত এই পরম্পরা থেকেই আধুনিক ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র উদ্ভব বলে মনে করেন অনেকে।

অষ্টাদশ শতকে রোমান্টিক ‘প্রেমের দিন’ ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ ইংল্যান্ডের যুবক, যুবতীদের প্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেই সময়ে বাণিজ্যিক ভাবে এই উৎসবের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। বসন্তের ফুল ফোটার আশায় প্রেমিক-প্রেমিকা, যুবক-যুবতী, এমনকি, স্কুলের ছাত্র, ছাত্রীরাও ভালবাসার নানা উপহার— লাল গোলাপ, ভ্যালেন্টাইন কার্ড, ইত্যাদি বিনিময় করেন। ইন্টারনেট সূত্রে জানা যায়, ১৮৩৫ সালে ইংল্যান্ডে পোস্টাল খরচ বেশি হওয়া সত্ত্বেও ৬০ হাজার ভ্যালেন্টাইন কার্ড পোস্ট করা হয়। পরে তার সংখ্যা দাঁড়ায় চার লক্ষে।

‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ সংস্কৃতির বিশ্বায়নের এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ১৪ ফেব্রুয়ারি পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক চোখ ঝলসানো বিজ্ঞাপনে সাজানো রঙিন ছবি চোখে ঘোর লাগায়। ভ্যালেন্টাইন ডে-র দিন যুবক, যুবতীরা কী ভাবে নিজেদের সাজাবেন এবং কী উপহার আনবেন তাঁদের প্রিয় মানুষটির জন্য, এই নিয়ে থাকে প্রচার। তাই গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে আসা কলেজে পড়া মেয়েটিও সে দিন নিজেকে সাজাতে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে লিপস্টিক বা ফেসক্রিম কিনে নেন। সিনেমা এবং টিভির চল আগে ছিল না। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার দৌলতে বিশ্বায়নের জমানায় গত শতকের শেষের দশকে অর্থাৎ ১৯৯২-৯৩ সালে ভারতে এর প্রবেশ। তার পরে এর রমরমা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

নিরপেক্ষ আলোচনায় আমরা মেনে নিতে বাধ্য, যে সংস্কৃতির বিশ্বায়ন অবশ্যম্ভাবী। সংস্কৃতির আঙিনায় কোনও ভেদ টানা যায় না। নিজের দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে কোনও দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি যদি বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়ে তাতে সে দেশের নাগরিকেরা গর্ববোধই করবেন। তাই সংস্কৃতির বিনিময় আবশ্যক। তবে শুধু পরের সংস্কৃতি গ্রহণ করলেই চলবে না। ভারতের সংস্কৃতিকেও এই সব দিনের অনুষঙ্গে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে হবে। সে জন্য দরকার সংস্কৃতির মেলবন্ধন। কেমন হয় যদি ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে দেশীয় ওডিসি, অসমের বিহু, বাংলার ছৌয়ের সম্মেলনে, আয়োজিত কোনও উৎসব বিদেশের মাটিতে মঞ্চস্থ হয় তবেই তো লাভ আমাদের শিল্পের। তাই সংস্কৃতি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে চাই আত্মীকরণের মাধ্যমে নিজস্ব ধারা নির্মাণও।

শিক্ষক ও গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE