বিজয় গোয়েল ও শোভা দে। ফাইল চিত্র।
দু’জনকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে চাই। দাঁড় করাতে চাই বললে বোধ হয় একটু কমই বলা হয়। বলা ভাল, প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতেই হবে।
প্রথম জন বিজয় গোয়েল। ভারতের ক্রীড়া মন্ত্রী।
অলিম্পিক্স শুরু হওয়ার পর থেকেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে দিচ্ছেন তিনি বার বার। লজ্জিত করছেন গোটা দেশকে। প্রথমে অলিম্পিক্সের আসরে গিয়ে বৈধ অনুমতিবিহীন পারিষদবর্গকে নিয়ে সংরক্ষিত অঞ্চলে ঢোকার চেষ্টা করলেন। কর্তৃপক্ষ চোখ রাঙিয়ে বললেন, বিধি ভাঙার চেষ্টা করলে বিজয় গোয়েলের অনুমতি পত্রও বাতিল হবে। ওই চোখ রাঙানি শুধু গোয়েলের ব্যক্তিগত অপমান কিন্তু নয়, গোটা ভারতের অপমান। কারণ তিনি ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মুখ হিসেবে রিওতে গিয়েছিলেন। জাতিকে এমন লজ্জার মুখে না ফেললেই পারতেন।
এতেই কি থামলেন মন্ত্রী? যে দীপা কর্মকারকে নিয়ে উদ্বেল গোটা দেশ, সেই দীপার নামটাই ভারতের ক্রীড়ামন্ত্রী ঠিক মতো জানেন না। বেশ স্পষ্ট করে প্রমাণ করে দিলেন তখন, যখন টুইটারে দীপাকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে কর্মকারের বদলে দীপার পদবী লিখলেন ‘কর্মনাকর’। সাবাশ বিজয় গোয়েল।
এই একটা মাত্র সাবাশি অবশ্য যথেষ্ট নয়। আরও আছে। শ্রাবণী নন্দকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে টুইট করলেন দ্যূতি চন্দের ছবি। কীর্তি দেখে সবাই যখন হো হো করে হাসতে শুরু করলেন, তখন তড়িঘড়ি টুইট প্রত্যাহার। এ বার শ্রাবণীর প্রতি শুভেচ্ছা টুইট করলেন ছবি ছাড়াই। কিন্তু খবরই রাখলেন না, শ্রাবণীর ইভেন্ট ততক্ষণে শেষ। শ্রাবণী ছিটকেও গিয়েছেন লড়াই থেকে।
বিজয় গোয়েল, আপনি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ক্রীড়ামন্ত্রী। অলিম্পিক্সের মতো আসর নিয়ে সক্রিয় হওয়ার আগে যৎসামান্য হোমওয়ার্কটুকু তো করতে হবে। কারা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন অলিম্পিক্সে, কারা এখনও জিইয়ে রেখেছেন ভারতের আশা, কার নাম কী— এই নেহাতই প্রাথমিক তথ্যগুলি আপনার কাছে অবশ্যই থাকা উচিত! না হলে হাসির রোল উঠবেই।
দু’জনকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে চাই বলেছিলাম। দ্বিতীয় জন শোভা দে। প্রখ্যাত লেখিকা।
ক’দিন আগে তিনিই বলেছিলেন, সরকারি খরচে ভারতীয় খেলোয়াড়দের অলিম্পিক্সে পাঠানো অর্থহীন। কারণ এঁরা পদক আনতে পারেন না।
প্রশ্ন হল, সরকারি খরচে এই ক্রীড়া মন্ত্রীকে অলিম্পিক্সে পাঠানোও যে অর্থহীন, সে কথাটা শোভা দে বললেন না কেন?
প্রশ্ন আরও আছে। ভারতীয় খেলোয়াড়দের কাছ থেকে অলিম্পিক্সে নিদারুণ সাফল্য আমরা কি আদৌ আশা করতে পারি? আমরা কি তা আশা করার যোগ্যতা রাখি? কী দিয়েছি বছরভর এই খেলোয়াড়দের, যে প্রতিদান আশা করব? ভাল অনুশীলনের পরিকাঠামো দিতে পেরেছি? ভাল কোচিং দিতে পেরেছি? উপযুক্ত সম্মান দিতে পেরেছি? দীপা কর্মকারকে নিয়ে এখন হইচই করছি। কিন্তু অলিম্পিক্স শুরুর আগে দীপা কর্মকারের নাম ক’জন জানতাম? পদকের তীব্র খরায় ভুগতে থাকা ভারতীয় অলিম্পিক্স দলের সামনে দীপা একমাত্র আশার আলো হয়ে না উঠলে, এখনও কি তাঁকে নিয়ে এত চর্চা করতাম আমরা? ক্রীড়া মন্ত্রী নিজেই ঠিক মতো জানতেন না তাঁর নামটা।
২০২০ সালে অলিম্পিক্সে সাঁতার কাটার স্বপ্ন দেখছে একটা মেয়ে। রেখা কুমারী তার নাম। ঝাড়খণ্ডের রাজ্য স্তরের সাঁতারু রেখা রোজ সকালে বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে একটি নদীবাঁধের জলাধারে সাঁতার অনুশীলন করে। অথচ বাড়ির কাছেই সরকারি সুইমিং কমপ্লেক্স রয়েছে। অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ। রেখার খোঁজ কেউ রাখেন না, তার স্বপ্নের খোঁজ কেউ রাখেন না, তার সমস্যাগুলোর খোঁজ কেউ রাখেন না, অব্যবহারে মলিন হতে থাকা রাঁচির সুইমিং কমপ্লেক্সটা খুলে দিলে রেখা কতটা এগিয়ে যেতে পারে, সে অনুভূতি কারও নেই। কিন্তু নিজের স্বপ্ন পূরণ করে রেখা যদি সত্যিই হাজির হতে পারে অলিম্পিক্সের আসরে, তা হলে নিন্দুকের অভাব হবে না। পদক আনতে না পারলেই শোভারা বলবেন, পাঠানোই উচিত হয়নি।
শোভা দে, খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে তো নিজের কলমটার খুব বলিষ্ঠ প্রয়োগ করলেন। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কলম গর্জে উঠল না কেন? মাথা হেঁট করে দেওয়া এই ক্রীড়ামন্ত্রী যে খেলাধুলার বিন্দুবিসর্গে উৎসাহী নন, তা কি ঠিক মতো স্পষ্ট নয় আপনার কাছে? অলিম্পিক্সে চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স দেওয়ার জন্য খেলোয়াড়দের যে সব সুবিধা দেওয়া দরকার, তা যে আমরা দিতে পারিনা, সে কি আপনার অজানা? পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও যে অলিম্পিক-স্বপ্ন দেখা এক সাঁতারু ভরা বর্ষায় বিপজ্জনক হয়ে থাকা জলাধারে সাঁতার কাটতে বাধ্য হচ্ছে, সে সব কি আপনার জানা নেই? সে ক্ষেত্রে আপনাদের মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
শুধু বলব, একটু হোমওয়ার্ক করে নিন। দেশের লজ্জা আর বাড়াবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy