Advertisement
E-Paper

ধর্মের নামে সিঁধ কাটা হচ্ছে, ‘শ্রেণির লড়াই’ জপে যাব?

গত এক দশকে বাংলার কোণে-কোণে রামদেব-সদ্‌গুরুর মতো নানা গুরুর বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। নানা টিভি চ্যানেলে নাম সংকীর্তন চলতে থাকে। কেউ এর বাইরে বেরোতে পারবেন না। লিখছেন সুমন সেনগুপ্তভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘সাধনা’ করছেন কেদারনাথে, সেটা ক্যামেরাবন্দি করে সারা ভারতের মানুষের কাছে দেখানোর মধ্যে দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাওয়া হল?

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৯ ০০:৩১

নির্বাচন শেষ হয়ে গিয়েছে। ফলাফলও সবাই জেনে গিয়েছেন। এর মধ্যে ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন বিরোধী দল ঐকমত্যে পৌঁছলেও কেউ পুরোপুরি ইভিএমকে দোষারোপ করতে পারছেন না। তাঁরা অনেকেই বলা শুরু করেছেন ফলাফল দেখে যে এটা অসম্ভব। কিন্তু তাঁরা যা-ই বলুন না কেন, একটা জিনিষ পরিষ্কার যে, ইভিএমে কিছু হোক ছাই না-হোক কোথাও একটা এমন কিছু ঘটেছে যা থেকে বলা যায় যে হিন্দু মনে কোথাও একটা বড়সড় কিছু একটা পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে।

তা না-হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘সাধনা’ করছেন কেদারনাথে, সেটা ক্যামেরাবন্দি করে সারা ভারতের মানুষের কাছে দেখানোর মধ্যে দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাওয়া হল? মানুষও সেগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। মানুষের মন এতটাই ফাঁপা হয়ে গিয়েছে যে তাঁরাও এই ‘সাধনা’-কে মনে করতে শুরু করেছেন যে, এটাই হয়তো ধার্মিক যাত্রা। যে মানুষটির মন প্রধানমন্ত্রীর নোটবন্দি ও জিএসটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল সেই মানুষটির মনও কি তবে হিন্দু হয়ে গিয়েছে? যে বাঙালিটির বিদ্যাসাগর নিয়ে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বা বাংলার অন্য মনীষীদের নিয়ে গর্ব ছিল, সেই মানুষটিও কি তবে মনে-মনে হিন্দু ছিলেন? সেই মানুষটিও কি তবে প্রথম থেকে মুসলমানদের ঘৃণা করতেন? তবে কি ‘বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি’ এই শব্দগুচ্ছের অস্তিত্বই ছিল না ? নাকি আসানসোলের দাঙ্গা বা ভাটপাড়ার দাঙ্গাই সত্যি?

অনেকে বলতেই পারেন, হিন্দু মন বলে কিছু হয় না। হিন্দুরা যথেষ্ট উদার। তাঁরা যথেষ্ট বৈচিত্রের কথা বলেন এবং শোনেন, তাঁদের মনে এত ঘৃণা নেই, তাঁরা অন্য জাতির প্রতি যথেষ্ট সহনশীল, তাঁরা অন্য ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল। তা হলে কী এমন ঘটল যে তাঁরাও এই ঘৃণা এবং বিদ্বেষ দেখাতে শুরু করলেন? আসলে গত এক দশকে ছোটখাটো নয়, একটা বড়সড় পরিবর্তন হিন্দু মননে ঘটে গিয়েছে যা হয়তো বা আমাদের অনেকের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে বা বলা ভাল অনেকেই হয়তো উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকার মধ্যে দিয়ে এই পরিবর্তনটা দেখেও না-দেখার ভান করেছেন। মরুঝড় এসে গিয়েছে, কিন্তু অনেকেই বলে গিয়েছেন যে শ্রেণির লড়াই দিয়ে এই বিপদ ঠেকানো সম্ভব। শ্রেণির লড়াই নিশ্চিত জরুরি হয়তো, কিন্তু শুধু শ্রেণির লড়াই করে কি এই ঘৃণা বিদ্বেষের পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া সম্ভব? নাকি আর কিছু করণীয় আছে যা অনেকেই ভাবতে চাইছেন না ?

যদি খেয়াল করা যায়, এই এক দশকে বাংলার কোনায়-কোনায় রামদেব-সদ্‌গুরুর মতো নানা গুরুর বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছে। আগে যেটা ছিল জ্যোতিষীদের দখলে সেই জায়গাটাই এখন মেডিটেশন, যোগাসন ইত্যাদির নামে এই বাবা কিংবা গুরুদেবরা দখল করেছেন। বিভিন্ন বড়ো প্রেক্ষাগৃহ থেকে শুরু করে নানা টিভি চ্যানেলে প্রায় সর্বক্ষণ এই নাম সংকীর্তন চলতে থাকে। কেউ এর বাইরে বেরোতে পারবেন না। মা-বাবারা বাচ্চাদের এই অশান্ত সময়ে শান্ত করার নানা পদ্ধতির মধ্যে এটাকেও একটা প্রকরণ বলে মনে করছেন। বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে গিয়েছে এ সব আর ঢুকবে না-ই বা কেন? যখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই তথাকথিত ধর্মগুরুদের ছবি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হয়, তখন এই ধর্মগুরুরা সহজেই প্রথমে বসার ঘরে তার পরে মানুষের শোওয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে এবং সহজেই মান্যতা পেয়ে যায়।

একটু পিছন ফিরলে হয়তো এই প্রশ্নের কিছু উত্তর পাওয়া যাবে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যখন গঠিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, তখন থেকেই হিন্দুদের জন্য যে এই ফাঁদটা পাতা হচ্ছিল সেটা কিন্তু অনেকেই সে দিন বুঝতে পারেননি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ‘সাধু’রাই যে ছদ্মবেশে এই হিন্দুত্বের মন্ত্র সমাজের মধ্যে ঢোকাবেন সেটা কিন্তু অনেকেই সে দিন আন্দাজ করতে পারেননি বা বলা ভাল, চাননি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কিন্তু একটি রাজনৈতিক সংগঠন যাকে চালানো হয়েছিল অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে। বজরঙ্গ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এরা কিন্তু এসেছিল ধর্মীয় অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এবং ধীরে-ধীরে তারা হিন্দুদের সমস্ত ধর্মীয় উৎসবগুলোকে কব্জা করার চেষ্টা করে গিয়েছে। এক দিকে মানুষ এদেরকে ভেবে এসেছে সাধু বা বৈরাগী যাদের কোনও সামাজিক বা অর্থনৈতিক চাহিদা নেই আর অন্য দিকে এরাই সংসদ ঘেরাও করেছে গোহত্যা বন্ধের দাবিতে যা সম্পূর্ণ ভাবে একটি রাজনৈতিক কাজ এবং যা পুরোপুরি দেশের এক অংশের বা সোজা করে বললে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গিয়েছে এবং প্রকারান্তরে যা ভারতীয় জনতা পার্টিকেই সহায়তা করেছে। অনেকেই সে দিন হয়তো হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু আজ তার ফল দেখা যাচ্ছে।

লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার

Religion Communalism Secularism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy