Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

আমরাও কি দেশের নাগরিক নই

সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, ভারতীয় রাষ্ট্রের যে কোনও নাগরিক তাঁর ইচ্ছানুসারে ধর্ম বিশ্বাস করতে পারেন, পালন করতে পারেন, আচরণ করতে পারেন।

সোহিনী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

আমার ঈশ্বরের কোনও সর্বজনগ্রাহ্য রূপ নেই। তবে কি আমার কোনও অধিকার নেই নিজের বিশ্বাসমতো আচরণ করার? আমি তো বিশ্বাস করি ঈশ্বর সমস্ত বিশ্বে পরিব্যাপ্ত— ঈশাবাস্যমিদ‌ং সর্বম্। আমি নিরীশ্বরবাদী নই: অপৌত্তলিক। আমিই একমাত্র নই, আমার মতো আরও অনেকেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, কিন্তু পৌত্তলিক নন। আবার এমন মানুষও আছেন যাঁরা নিরীশ্বরবাদী, আরও কেউ থাকতে পারেন যিনি প্রকৃতই নাস্তিক। হয়তো তাঁদের সংখ্যা বেশি নয়, কিন্তু তাঁরা আছেন। এবং তাঁরাই সংখ্যালঘু— এখন, এ দেশে।

সংবিধানের ৪২তম সংশোধনী অনুযায়ী ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ‘সেকুলার’। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র অর্থ খুব কঠিনও নয়। তবু কেন যে শব্দটা নিয়ে এত ধোঁয়াশা! সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, ভারতীয় রাষ্ট্রের যে কোনও নাগরিক তাঁর ইচ্ছানুসারে ধর্ম বিশ্বাস করতে পারেন, পালন করতে পারেন, আচরণ করতে পারেন। কিন্তু কেউ কি নিজের বিশ্বাস, নিজের পালন, নিজের আচরণ জোর করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন? কোনও সম্প্রদায় কি নিজের ধর্মাচরণের উল্লাস অন্যের ওপর আরোপ করতে পারেন? সংবিধান সম্ভবত সে অধিকার কাউকে দেয়নি।

প্রসঙ্গত স্মরণীয়, চার্চ অব গড ইন ইন্ডিয়া বনাম কে কে আর ম্যাজেস্টিক কলোনি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন মামলা (২০০০)। সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল, ‘‘এ বিষয়ে বিতর্ক থাকতে পারে না যে কোনও ধর্ম কখনও বলে না অন্যের শান্তিতে বিঘ্ন ঘটিয়ে প্রার্থনা করতে হবে। এ কথাও বলে না যে মাইক বাজিয়ে ড্রাম পিটিয়ে ধর্ম প্রচার করতে হবে।’’

এ দেশে ‘সংখ্যাগুরু’ ‘সংখ্যালঘু’ শব্দগুলি, কী আশ্চর্য, শুধু ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রসঙ্গেই অনিবার্য ভাবে ব্যবহৃত হয়। আরও আশ্চর্য, ‘সংখ্যালঘু’ বললে কেমন ভাবে যেন একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ই চিহ্নিত হয়ে যায়। কী বিপজ্জনক আগ্রাসী ব্যবহার বিশেষ বিশেষ শব্দের, অথচ আমরা উদাসীন! এই দায়িত্ববোধহীন ভাষা ব্যবহার আমাদের শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে ফেলবে, ভাবতেও ভয় হয়।

অথচ ধর্মাচরণ প্রসঙ্গেই বুঝে নেওয়া জরুরি, ‘স‌ংখ্যালঘু’ বলতে কোন কোন ধর্ম সম্প্রদায়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়? মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-জৈন? আর ভারতরাষ্ট্রে ‘স‌ংখ্যাগুরু’ হল হিন্দুরা? কোন হিন্দু? শৈব, শাক্ত, সৌর, বৈষ্ণব, এদের মধ্যে কে কে? ব্রাহ্মরাই বা কোন দলে পড়বেন? যে ‘হিন্দুধর্ম’ নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা আসর গরম করতে চান, সে হিন্দুধর্মের চেহারাটা কী? সে কি আসলে ইউপিএ বা এনডিএ-র মতোই নানা ফুলের গুচ্ছ নয়? সংখ্যাগুরুর জোর তবে আসছে কোথা থেকে?

কেন এ সব কথা আসছে? কারণ আমাদের সহ্যের ক্ষমতাটাকে আর যেন বাড়ানো যাচ্ছে না। প্রতি মাসেই কোনও না কোনও সম্প্রদায়ের গা-জোয়ারি ধর্ম পালনের উৎকট অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। বোঝা যায় না, ধর্মাচরণ পদ্ধতি কেন ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে না! কেন ধর্ম পালন করে কেউ? নিজেদের ক্ষমতা বোঝাতে? না কি ধর্ম পালনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক রকমের কল্যাণ কামনা, সে ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সম্প্রদায়গত, যা-ই হোক না কেন? ধর্ম-প্রতিযোগিতার উন্মত্ততায় ধর্মের মূল উদ্দেশ্যই যেন ব্যাহত হতে বসেছে।

‘মাধুকরী’র এমন সুন্দর উদ্দেশ্য বন্ধ হয়ে গেল কত কাল। বহু জনের অংশগ্রহণে সমগ্রের কল্যাণকামনাই তো ধর্ম! সে ধর্ম পালনে আজ অনীহা। আগ্রহ কেবল কর্পোরেট ভিক্ষায়! আর রয়েছে সরকারি দাক্ষিণ্য। রাজ্যের আঠাশ হাজার পুজো কমিটিকে দশ হাজার টাকা করে অনুদান, মোট ব্যয় আঠাশ কোটি! এই ব্যয় কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দল করছে না। করছে রাজ্য সরকার। দাতব্য সরকারের, টাকা জনগণের। আচ্ছা, আমাকে তো প্রশ্ন করা হল না যে এই টাকা আমি পুজোয় ব্যয় করার জন্য অনুমতি দিচ্ছি কি না। এই আঠাশ কোটি করের টাকায় তো আমারও অংশগ্রহণ আছে। সংবিধানের ২৭ নম্বর ধারা বলছে, ‘‘কোনও বিশেষ ধর্মের প্রসার বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনও নাগরিককে কর দিতে বাধ্য করা যাবে না।’’ না, ঠিক ধর্মের নামে কর ধার্য করা হয়নি, কিন্তু এটাও তো ঠিক যে প্রদত্ত কর ধর্মীয় উৎসবে ব্যবহার করা হচ্ছে, করদাতাদের অনুমতি ব্যতিরেকেই!

পূজার্চনা এবং উৎসব— দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। ধর্মের সঙ্গে উৎসব জুড়তে পারে, কিন্তু ধর্মপালন কি উৎসবসর্বস্ব হতে পারে? উৎসব ধর্মীয় হতে পারে, ধর্মবিহীনও হতে পারে। ধর্মীয় উৎসব পালনে অধিকাংশের যে রকম উৎসাহ, দেখে মনে হয় যেন কোথাও একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সবাই। যে ভাবেই হোক, কোনও না কোনও সম্প্রদায়ভুক্ত হতে চাইছে। যেন ভূতের ভয়ে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়াস।

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? ধর্ম বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকা। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক যাতে তাঁদের পছন্দমতো ধর্ম পালন করতে পারেন তা দেখা। রাষ্ট্র পাহারাদার। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি ঠিক বিপরীতটাই। রাষ্ট্র যেন সমস্ত ধর্মের বা কোনও কোনও ধর্মের ঠিকাদারি নিয়েছে। কোনও ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ ধর্মের, আবার কোনও ক্ষেত্রে অনেকগুলি ধর্মের ঠিকাদার। ঠিকাদারদের মতলব মুনাফার দিকে। তাই পুজোর প্যান্ডেল ফুটপাত ছাপিয়ে রাস্তায় নামে, প্রশাসন চুপ। রাস্তা আটকে করসেবা চলে, প্রশাসন চুপ। রাস্তা কারবালায় পরিণত হয়, প্রশাসন চুপ। জগন্নাথের রথ চলার জন্য পথ মসৃণ করে প্রশাসন— মুমূর্ষু রোগীর জন্য নয়। মহাদেবের মাথায় জল ঢালার জন্য গোটা শ্রাবণ মাস জুড়ে কী ভয়ানক বিভীষিকা, যাঁদের বাড়িতে রোগী আছেন, তাঁরাই বোঝেন। মাইকের অত্যাচারে নাজেহাল নাগরিক তবে কার কাছে যাবেন?

যে রাষ্ট্রের পাহারাদার হওয়ার কথা ছিল, সে হল ঠিকাদার। রাজনৈতিক দলগুলি কখনও ‘হিন্দু’, কখনও ‘অসাম্প্রদায়িক’ হওয়ার ব্যস্ততায় নিজেদের কর্তব্য ভুলেছে। সাম্প্রতিক কালে তো রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে কে কত বড় হিন্দু তা প্রমাণের!

আমরা যাঁরা অপৌত্তলিক, কিংবা নিরীশ্বরবাদী, কিংবা নাস্তিক— আমরা যাঁরা প্রকৃতই সংখ্যালঘু, তাঁদের অবস্থান বরং অনেক স্পষ্ট। অন্যের উৎসবে আমন্ত্রিত হলে আমরা যোগ দিই। আমাদের নিজেদের ধর্মাচরণ একান্ত ব্যক্তিগত, অন্যদের বিরক্ত করি না, অত্যাচার করি না। বড়জোর বিতর্কে যাই। অনেকে তা-ও করেন না। কিন্তু আমরা অন্যান্য সম্প্রদায়ের দ্বারা অত্যাচারিত হই। আমরা বাধ্যত ভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মপালনের উৎকট উল্লাসে ছিন্ন হই। সংবিধান কি আমাদেরও রক্ষা করার কথা বলেনি? আমরাও কি ভারত-রাষ্ট্রের নাগরিক নই?

বিদ্যাসাগর কলেজে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Secularism Concept Constitution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE