Advertisement
E-Paper

রোহিঙ্গাদের প্রতি দায় আছে আমাদেরও

মায়ানমারের রোহিঙ্গারা বার বার আশ্রয় খুঁজেছেন বাংলাদেশে, বারে বারে অনাহূত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন সেখানে এবং তার পর তাইল্যান্ড, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায়। এখন সেই ইতিহাস এক মর্মান্তিক আকার নিয়েছে।দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অত্যন্ত বিপদসংকুল নৌপথে যে শরণার্থীরা আসছেন তাঁদের আশ্রয় না দেওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন তুলেছে। বেশির ভাগই মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর মানুষ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এ ভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা কিন্তু এই অঞ্চলে বিরল বা নতুন নয়।

সুচরিতা সেনগুপ্ত ও মধুরা চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৫ ০০:০২
নিঃসহায়। নৌকোয় ভাসমান কিছু রোহিঙ্গা মানুষ। আন্দামান। মে ২০১৫। ছবি: এএফপি।

নিঃসহায়। নৌকোয় ভাসমান কিছু রোহিঙ্গা মানুষ। আন্দামান। মে ২০১৫। ছবি: এএফপি।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অত্যন্ত বিপদসংকুল নৌপথে যে শরণার্থীরা আসছেন তাঁদের আশ্রয় না দেওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন তুলেছে। বেশির ভাগই মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর মানুষ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এ ভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা কিন্তু এই অঞ্চলে বিরল বা নতুন নয়।

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত মায়ানমারের প্রধানমন্ত্রী উ নু-র গণতান্ত্রিক সরকার রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, পরবর্তী সামরিক রাষ্ট্র তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে। স্বাধীনতার পরে সারা দেশ জুড়ে শুরু হয় বর্মীয় সংখ্যাগুরুদের বিরুদ্ধে নানা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহ। রোহিঙ্গারা আরাকানে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র দাবি করেন, যেমন করেন মায়ানমারের নানা প্রান্তে অবস্থিত কাচিন, চিন ইত্যাদি গোষ্ঠীর মানুষ। ১৯৭৪ সালে সামরিক রাষ্ট্রের নতুন আইন, ইমার্জেন্সি সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করে। ১৯৭৮-এ সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে শুরু হয় অপারেশন নাগা মিন। প্রচণ্ড অত্যাচার ও নিপীড়নের সম্মুখীন হয়ে দুই লক্ষ রোহিঙ্গা মানুষ নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম প্রদেশে আশ্রয় খুঁজতে আসেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর অনুমান, ১২,০০০ মানুষ মারা যান, কারণ বাংলাদেশ সরকার তাঁদের ফেরত যেতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে খাবার দিতে চাননি। ১৯৭৯ সালে মায়ানমার-বাংলাদেশ চুক্তির ফলে রোহিঙ্গাদের উত্তর আরাকানে প্রত্যাবাসনে বাধ্য করা হয়। ১৯৮২-র সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ভাবে মায়ানমারে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে। এর পরে বারে বারে আঘাত নেমে এসেছে রোহিঙ্গা মানুষদের উপরে। ১৯৯০ ও সাম্প্রতিক ২০১২-র জাতিবাদী দাঙ্গা প্রকাণ্ড ইসলাম বিদ্বেষী এক কাণ্ডে পরিণত হয়। ২০১২-র রোহিঙ্গা বিদ্বেষী দাঙ্গায় ছাড় পাননি কামান মুসলমান বা অন্যান্য মুসলমান গোষ্ঠীরাও, যাঁদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি আছে। রোহিঙ্গা বিদ্বেষের সূত্রপাত ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় থেকেই। আর এখন মায়ানমারে তৈরি হয়েছে এমন এক ইসলাম বিদ্বেষী হাওয়া যে, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সু চি অবধি রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেন না, উল্টে বলেন, মায়ানমারে যে মুসলমানরা থাকেন তাঁদের বর্মীয় সমাজে একীভূত হতে হবে!

বারে বারে রোহিঙ্গারা আশ্রয় খুঁজেছেন বাংলাদেশে, বারে বারে অনাহূত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন সেখানে এবং তার পর তাইল্যান্ড, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায়। বাংলাদেশ সরকার বহু দিন ধরেই স্পষ্টত বলে দিয়েছে, তারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে রাজি নয়। ১৯৯২ থেকে বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনএইচসিআর নতুন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের স্বীকৃতি দান বন্ধ করেছে। নথিভুক্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাংলাদেশে প্রায় ২৮,০০০। এঁরা আছেন কুতুপালং ও নয়াপাড়া ক্যাম্প-এ। তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন এ দুটি ক্যাম্পের বাইরে। জুলাই ২০১২’য় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর বর্তায় না, বরং মায়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা হোক, যাতে তারা রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়। আওয়ািম িলগ রোহিঙ্গাদের জামাতে ইসলামির অনুগত ভাবার ফলে আরও এই বিরূপ মনোভাব। ২০১৪’য় বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ হয়। ২০০৭-০৮-এর নতুন ভোটার লিস্টে নথিভুক্ত উদ্বাস্তু নয় এমন রোহিঙ্গাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। ইউএনএইচসিআর সূত্রে রোহিঙ্গাদের বিদেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও সরকার বন্ধ করে দেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, যে এই কারণেই আরও বেশি রোহিঙ্গা আসছে বাংলাদেশে।

রোহিঙ্গারা ফলত আরও ছড়িয়ে পড়েছেন, চেষ্টা করছেন স্থলপথে বাংলাদেশ দিয়ে ভারতে বা জলপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঢোকার। জাতিদাঙ্গায় বিধ্বস্ত মায়ানমারের আরাকান প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গারা আসছেন এ দেশে, বাঁচার তাগিদে, আশ্রয়ের খোঁজে। মায়ানমারে তাঁদের স্বীকৃতি নেই। তাই বাংলাদেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকা, জামালপুর, রংপুর হয়ে ছিন্নমূল মানুষগুলো প্রধানত দক্ষিণ দিনাজপুরে হিলি সীমান্তের পথ ধরে ঢুকছেন ভারতে। গন্তব্য: জম্মুতে ইউএনএইচসিআর স্বীকৃত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেয়, পরিচয়পত্র ও রিফিউজি কার্ডও দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতে তাঁরা সচরাচর পরিচিত অনুপ্রবেশকারী রূপে। অনুপ্রবেশ আইনের জটিলতা ও আধিকারিকদের অজ্ঞতার ফল হল ক্লান্ত ক্ষতবিক্ষত পায়ে পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাজার যোজন পেরিয়ে আসা এই সহায় সম্বলহীন মানুষগুলির কারাবাস। এ দেশে অনেকেরই নতুন ঠিকানা হয় সংশোধনাগার। ভাষার ব্যবধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রধান সমস্যা। তাঁরা বুঝতেও পারেন না কিছু, বোঝাতেও পারেন না নিজেদের কথা ও দেশ ছাড়ার কারণ।

ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের তত্ত্বাবধানে গবেষণার কাজে আমরা যখন ডিসেম্বরে বালুরঘাট সংশোধনাগারে গেলাম তখন সেখানে সরকারি ভাবে রোহিঙ্গা মহিলাদের সংখ্যা ছিল ৮, পুরুষ ১১, শিশু ৩। এরা মায়ানমারের রাখিন জেলার ফান্সি, কুয়ারবিল, বালিবাজার, বুগ্রিশ এবং গোহবাজার এলাকা থেকে ২০ জনের একটি ছিন্নমূল দলের অংশ হিসেবে আসেন। আমিনা, আনোয়ারা, নুরজাহান, তসলিমা, রিজিয়া, শামিলা, মুমতাজ বেগম, জেইনাব, প্রত্যেকেই দ্বিধাহীন ভাবে স্বীকার করেন যে, সুদীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা, বিশেষ করে ২০১২’য় শুরু হওয়া জাতিদাঙ্গা ও অমানবিক হিংসা তাঁদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনযাপন, ধর্মীয় প্রার্থনা ও পড়াশুনার জন্য বাড়ি থেকে বেরনো তো আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তার সঙ্গে তাঁদের ছোট ছোট ছেলেমেদেরও মাদ্রাসায় যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। তাঁদের স্বামীরাও অনুপস্থিত, অধিকাংশই হয় বর্বরোচিত মারণযজ্ঞের শিকার, নয়তো পলাতক। নুরজাহানরা যেতে চেয়েছিলেন জম্মুতে শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু তাঁদের স্থান হল সংশোধনাগারে— কখনও বালুরঘাট, কখনও বহরমপুর, কখনও বা দমদম। কারা দফতরের হিসেব অনুযায়ী এ বছরের গোড়ায় বহরমপুরে অভিযুক্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল ৯, দমদমে ১৫ ও বালুরঘাটে ৩০ জন বিচারাধীন। নিজভূমে ফেরার অধিকার তাঁদের নেই। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তাঁদের ঠেলা হয় বাংলাদেশের দিকে, কিন্তু তাঁরা তো আসলে বাংলাদেশি নন। অগত্যা দিনের পর দিন বিচারাধীন বন্দির তকমা নিয়েই সংশোধনাগারে কালাতিপাত। ভারতীয় সংশোধনাগারে যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা ‘জান খালাস’ শিরোপাযুক্ত, তাঁদের অধিকাংশের মুক্তি আসন্ন। কিন্তু রোহিঙ্গা মুমতাজ বেগমদের কী হবে, যাঁরা কেউ উনিশ মাস কেউ একুশ মাস কেউ বা তার বেশি সময় ধরে বিচারাধীন বন্দি, এক দিনের জন্যও যাঁদের বিচারপতির এজলাসে পেশ করা হল না আইনি জটিলতায়? জেইনাব (৩০ বছর) বালুরঘাটে কাটিয়ে ফেলেছেন এক বচ্ছর ন’মাস, কিন্তু এখনও তাঁর কেস কোর্টে ওঠেনি। চার সন্তান জেলের নির্ধারিত দুটি হোমে স্থান পেয়েছে। তাদের সঙ্গে দেখা হয়ই না। জেইনাবের মতো সংশোধনাগারে থাকা রোহিঙ্গা মহিলাদের শিশুরা, যাদের অতি কষ্টে পাহাড় জঙ্গল ডিঙিয়ে তাঁরা প্রাণে বাঁচিয়ে আনতে পেরেছিলেন, তারা মাতৃস্নেহে বঞ্চিতই থাকে। তাদের ঠিকানা হয় অন্যত্র, বিভিন্ন হোমে বাংলাদেশি শিশুদের সঙ্গে। ইউএনএইচসিআর-এর দিল্লির কার্যালয়ে বালুরঘাট সংশোধনাগার থেকে বেশ কয়েক বার যোগাযোগ করা হয়েছে যাঁদের রিফিউজি কার্ড রয়েছে তাঁদের শরণার্থী শিবিরে পুনর্বাসনের জন্য। কিন্তু অন্য সংশোধনাগারগুলিতে থাকা রোহিঙ্গাদের অপেক্ষা হয়তো অন্তহীন।

আজ যে দেখছি এই ছিন্নমূল মানুষদের দেশে দেশে প্রত্যাখ্যান, যখন তাঁরা খিদে তেষ্টায় মারা যাচ্ছেন তখনও রেহাই নেই— কোনও দেশই তাঁদের দায় নিতে চায়নি। প্রথম ভাসমান কবরটি খবরের কাগজের পাতায় আসার কয়েক দিন আগে, ৮ মে, ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, জলপথে মানুষ পাচারের ঘটনায় তাঁরা খুবই উদ্বিগ্ন। তাঁদের রিপোর্ট অনুযায়ী এ বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ২৫০০০ রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি মানুষ পাচাকারীদের নৌকায় পাড়ি দিয়েছেন, ২০১৪’য় যে সংখ্যা ছিল এর অর্ধেক। এর কিছু দিন পূর্বেই তাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার সীমান্তে পাওয়া যায় গণকবর ও পাচারকারীদের ক্যাম্প। মালয়েশিয়াতেও জঙ্গলে পাচারকারীদের ক্যাম্প ও গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মানুষদের কাছে আমরা এ-ও জেনেছি, তাঁরা কী ভাবে পাচারকারীদের অত্যাচার, লাঞ্ছনার বলি হয়েছেন।

যখনই কোনও সন্ত্রাসী হামলা হয়, অমনি ভারতের মিডিয়ার চোখ চলে যায় ভারতে আশ্রিত আট হাজার রোহিঙ্গাদের দিকে। গত বছর খাগরাগোড়ে বিস্ফোরণের পরে যখন এক জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসবাদীকে হায়দরাবাদের উদ্বাস্তু ক্যাম্প থেকে গ্রেফতার করা হয়, তখন আমরা দেখেছি সরকার পশ্চিমবঙ্গের জেলে রোহিঙ্গা অনুপ্রেবেশকারীদের সংখ্যা দেখে কী রকম চিন্তিত হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের ছিন্নমুল অবস্থা তাদের উগ্রপন্থার দিকে ঠেলে দিছে— এই মর্মে অনেক আলোচনাও হয়েছে। অথচ, কোনও সমাধানের পথ খুঁজে বার করা হয়নি।

তাইল্যান্ড, মায়ানমারের মতো দেশের সমালোচনায় আমরা মুখর, কিন্তু আমাদের কি মনে রাখা উচিত না, যে আমাদেরও দায়িত্ব আছে? জেল এবং ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ তকমা কখনওই সমাধানের পথ নয়। আমাদের সরকারকে দেখতে হবে যাতে এই মানুষেরা যেন নিছক বহিরাগত হিসেবেই চিহ্নিত না হন। ভারতে যেন তাঁরা পৃথিবীর নাগরিক হিসাবে মর্যাদা পান।

দ্য ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এ গবেষক

rohingya sucharita sengupta Madhura Chakroborty Asia myanmar Islam China
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy