অসহায়: মা ও সদ্যোজাত। নিজস্ব চিত্র
কথিত আছে, একটি চিত্র সহস্র শব্দরাজি অপেক্ষা অধিকতর ব্যঞ্জনাময়। সহস্র শব্দ লিখিয়াও যাহা পরিস্ফুট করা যায় না, তাহা একটিমাত্র ফোটোগ্রাফে প্রকাশিত হইতে পারে। লালগড়ের আজনাশুলি গ্রামসংলগ্ন পাখিবাঁধ এলাকার একটি সংবাদ এই দৈনিকে মুদ্রিত হইয়াছে, সঙ্গের চিত্রে দেখা যাইতেছে এক হস্তিনী তাহার সদ্যমৃত শাবকটিকে অপার অপত্যস্নেহে পাহারা দিতেছে। অন্তঃসত্ত্বা হস্তিনীটি দলের সঙ্গে লোকালয়ে প্রবেশ করিয়া ধানখেতে একটি শাবক প্রসব করে। দলের অন্য হস্তিকুল তাহাকে এবং তাহার সদ্যোজাত সন্তানটিকে ফেলিয়া পুনরায় জঙ্গলে চলিয়া যায়। খবর রটিবামাত্র আশেপাশের গ্রামগুলি হইতে লোকজন ভিড় করে হস্তিনী ও তাহার সদ্যোজাত সন্তানটিকে দেখিতে। শুধু দেখিলে কি চলে? কে কতখানি সমীপবর্তী হইল হস্তিনী এবং তাহার শাবকের, তাহা প্রমাণের জন্য মুঠাফোনে ফোটো সংগ্রহের লক্ষ্যে শুরু হয় হুড়াহুড়ি। ভিড়ের মধ্যে প্রাণবায়ু নির্গত হয় শাবকটির। ক্ষিপ্ত সন্তানহারা জননীর রোষের শিকার হয় চতুর্দিকে ভিড় জমানো গ্রামবাসীগণ, যাহারা ব্যস্ত ছিল ফোটো এবং ভিডিয়ো সংগ্রহে। ক্রোধোন্মত্ত হস্তিনীটি তাড়া করে গ্রামবাসীগণকে, শৈলেন মাহাতো নামে এক জনকে পিষিয়া হত্যা করে। প্রশিক্ষিত বনকর্মীরা খবর পাইয়া অকুস্থলে ছুটিয়া আসেন, সন্তানহারা জননী হস্তিনীটিকে জঙ্গলের দিকে লইয়া যান ও মৃত শাবকটিকে উদ্ধার করেন। তাঁহারা বিপদভঞ্জনের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হইলে স্থূল আমোদ-অন্বেষণের ফল আরও কত গড়াইত কে জানে।
মানুষের স্থূল আমোদপ্রিয়তার নিকৃষ্ট দিকটি এই ঘটনায় প্রকাশিত। এ দেশের জনতা অনাবশ্যক রকমের হুজুগপ্রিয়। হুজুগটি যতই স্থূল, ততই তাহা আকর্ষক। সদ্যোজাত শাবক-সমেত হস্তিনীটিকে না দেখিলে গ্রামবাসীগণের উদরস্থ অন্ন হজম হইত না, এমন নহে। অথচ, অমুকে যাহা দেখিল, তাহা আমি দেখিতে না পারিলে আমার জীবন বৃথা, এই চিন্তাই ভিড়ের উৎস। ইহার সঙ্গে অধুনা যুক্ত হইয়াছে অপর এক প্রবৃত্তি। মুঠাফোনে দৃশ্য হস্তগত করিবার উদগ্র বাসনা। স্মার্টফোনের দৌলতে সকলেই চিত্রগ্রাহক, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সকলেই ফোটো তুলিতে ব্যস্ত। চিত্রের মধ্যে নিজেকে গুঁজিয়া দিতে পারিলে তো সোনায় সোহাগা! সিগমন্ড ফ্রয়েড জীবিত থাকিলে নার্সিসিজ়ম-এর জোয়ার দেখিয়া কৌতুক বোধ করিতেন। ভিড়ের হুজুগে শামিল হইবার এবং স্থির ও চলমান দৃশ্য হস্তগত করিবার বাসনাই শৈলেন মাহাতোর মৃত্যুর কারণ। ভাবখানা এই: সম্ভাব্য পরিণামের চিন্তায় আমোদে অংশ লইবার বাসনা ত্যাগ করে কোন মূর্খ? ।
লালগড়ের ঘটনাটির দ্বিতীয় দিকটি গূঢ়। তাহা জন্তু-জানোয়ারের মন-সংক্রান্ত। মনুষ্য যাহাকে মন কহে, তাহা কি পশুর আছে? প্রশ্নটি জীববিদ্যাবিশারদগণের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘দি এক্সপ্রেশনস অব ইমোশনস ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিম্যালস’ গ্রন্থে চার্লস রবার্ট ডারউইন দাবি করেন মনুষ্যের ন্যায় পশুরও ইমোশন বা আবেগ আছে। শতাব্দীর অধিক কাল পর্যন্ত পণ্ডিতগণ বইটির প্রতিপাদ্য অবজ্ঞা করিয়াছিলেন। ফলে এই ধারণা জীববিজ্ঞানীকুলে বদ্ধমূল হয় যে, পশুদের মনুষ্যসুলভ ভাবনা নাই। পশুরা কী উপলব্ধি করিতেছে, তাহা যে হেতু বলিতে পারে না, উহাদের আচরণ শুধুমাত্র প্রবৃত্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবেগ বা সহমর্মিতার মতো যে গুণগুলি মনুষ্যের আছে, তাহা উহাদের নাই। আধুনিক জীববিজ্ঞানীগণ কিন্তু এই ধারণা ত্যাগ করিয়াছেন। মানসিক ক্ষমতায় বিভিন্ন পশু মানুষের কতটা সমীপবর্তী, তাহা কগনিটিভ সায়েন্টিস্টদের গবেষণার এক বড় বিষয়। এ দেশে ওই শ্রেণির বিশেষজ্ঞদের উচ্চবাচ্য বিশেষ শুনা যায় না। অন্যথায় লালগড়ের সন্তানহারা হস্তিনীটি গবেষণার বিষয় হইতে পারিত। ওই জননী যে ভাবে অপত্যস্নেহ প্রদর্শন করিয়াছে, তাহা একমাত্র মনুষ্যসমাজেই দেখা যায়। প্রসঙ্গত সদ্যপ্রকাশিত একখানি গ্রন্থ স্মর্তব্য। লেখক প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ফ্রান্স ডি ওয়াল। গ্রন্থের নাম— ‘মামা’স লাস্ট হাগ: অ্যানিম্যাল ইমোশনস অ্যান্ড হোয়াট দে টিচ আস অ্যাবাউট আওয়ারসেলভ্স’। গ্রন্থটির শিরোনাম তিনি আহরণ করিয়াছেন মামা নামক এক শিম্পাঞ্জির জীবনের অন্তিম মুহূর্ত হইতে। একটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। ৫৮ বৎসর বয়সি মামা যখন অন্তিমশয্যায় শয়ান, তাহার সঙ্গে দেখা করেন বিজ্ঞানী জান ভান হুফ, যিনি একদা মামা-র পরিচর্যায় শামিল ছিলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র মৃত্যুপথযাত্রী মামা অতি কষ্টে গাত্রোত্থান করে এবং হুফ-কে আলিঙ্গন করে।
যৎকিঞ্চৎ
যদিও বিজ্ঞাপন বলছে, ভোট শেষ পুজো শুরু, আসলে ভোট শেষ বিশ্বকাপ শুরু। সবাই তাকিয়ে আছে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দিকে, ওই দিন টিভির সামনে গাঁকগাঁকিয়ে দেশপ্রেম উগরে দেবে। যদি ভারত জেতে? বিরিয়ানি অর্ডার, ফেসবুকে পাক-থেঁতো, হয়তো সরকার থেকে মাগনা লাড্ডু। যদি ভারত হারে? বোঝা যাবে, আম্পায়ারের ঘৃণ্য চক্রান্ত, আসলে পাকিস্তানের অনেক উইকেট দুমদাম ফেলা হয়েছিল, কিন্তু কেন কে জানে, টিভিতে দেখা যায়নি। প্রমাণ চাইলে, তুমি দেশদ্রোহী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy