Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সাক্ষরতার স্বাস্থ্যরক্ষা

হয়তো ভাবছেন, এ দেখছি টুলো পণ্ডিত, এই ছুতোয় মাস্টারি করে নিচ্ছে। বানানের ঠিকভুলের ছুতোয় লোকটা নির্ঘাত বলবে পুজোকে ‘সার্বজনীন’ বলা ব্যাকরণবিরুদ্ধ, সর্বদা বলতে হয় ‘সর্বজনীন’।

প্রবাল দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

নিরক্ষরতা দূর করা অবশ্যই উন্নয়নের সূচক, মানছি। কিন্তু কেবল ওই দিকেই নজর রাখলে সাক্ষরতার স্বাস্থ্যের প্রশ্নটা কি চাপা পড়ে যায় না? শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখবার চেনা উপায়, নিয়মিত হাঁটাচলা করা। কিন্তু হাওয়ায় যদি প্রচণ্ড দূষণ থাকে তা হলে হিতে বিপরীত হবে, ফুসফুস খারাপ হয়ে যাবে। তেমনই ধরে নিন, সাক্ষরতার স্বাস্থ্যরক্ষার সোজা উপায় রোজ খানিকটা পড়া। কিন্তু চার পাশে যে সব লেখা আপনি না পড়ে পারেন না— রাস্তায় টাঙানো বিজ্ঞপ্তি, অফিসকাছারি-দোকানপাটের নামধামের ফলক, দোকানের সামনে টাঙানো খাবারের মেনু— সেখানে ভুলভাল বানানের ছড়াছড়ি। ওইগুলোকে আপনার চোখ যদি সানন্দে অভ্যর্থনা জানাতে থাকে, তা হলেও তো হিতে বিপরীত হবে, তাই না? বানানের ঠিক-ভুলের বোধটাই হারিয়ে যাবে, সর্দির সময় যে রকম গন্ধের বোধ হারিয়ে যায়। কোথাও ‘বিজ্ঞাপন’-কে ‘বিঞ্জাপন’ লিখেছে দেখলে চমকাবেন না। ‘করুন’ অর্থে ‘করুণ’ দেখে চিত্তে করুণরসের স্রোতও বইবে না।

হয়তো ভাবছেন, এ দেখছি টুলো পণ্ডিত, এই ছুতোয় মাস্টারি করে নিচ্ছে। বানানের ঠিকভুলের ছুতোয় লোকটা নির্ঘাত বলবে পুজোকে ‘সার্বজনীন’ বলা ব্যাকরণবিরুদ্ধ, সর্বদা বলতে হয় ‘সর্বজনীন’। দৃষ্টান্তটা ইচ্ছে করেই বাছলাম। আমার রসিক বন্ধু শিশির ভট্টাচার্য এই বহুপ্রচলিত ভুল বানানের হয়ে কপট সওয়াল করেছেন, “আলবত ‘সার্বজনীন’ বলতে হবে। হিন্দুধর্মে নিরাকার উপাসনা আছে নাকি?’’ না, বানানের জঞ্জাল সাফ করবার অছিলায় সেকেলে বৈয়াকরণদের মতো পিটপিটানির ফর্দ তৈরির ছক কষছি না। ‘সর্ব’ থেকে ‘সার্ব’ স্রেফ বানানে আলাদা নয়, উচ্চারণেও আলাদা। ওখানে যার যা আপত্তিই থাকুক, বিষয়টা বানান নয়, শব্দগঠনের অনুপুঙ্খ।

অন্য দিকে, পুরনো বানান আর নতুন বানানের কাজিয়া দেখে দেখে লোকে হদ্দ হয়ে গিয়েছে। ওই বস্তাপচা বিষয়টাকে আবার ফিরিয়ে আনা কেন? উত্তরে জোর দিয়ে বলব, রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কথা বলছি। ফিনাইল মেশানো জল দিয়ে ঘর মুছবার কথা বলছি না। ‘নামাবলী’ না কি ‘নামাবলি’, এ তেমন তর্জা নয়। খোলসা বানান, যেগুলো নিয়ে বিতর্ক নেই, অন্তত সেগুলো নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হওয়া দরকার। ভুল বানান নিয়ে উদ্বেগ ‘বস্তাপচা বিষয়’ বলে সরিয়ে রাখা যায় না।

কেউ হয়তো কঠোর স্বরে বলবেন, “ছি ছি, যাঁরা দোকান চালান তাঁরা উচ্চবর্গের নন বলে হেনস্থা করছ! দোকানদারদের ভুল বানান নিয়ে ঠাট্টা!” এঁরা মনে করেন, ভুল বানানের প্রতিবাদ করলে দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত মানুষের অমর্যাদা করা হয়। কিন্তু যাঁরা নানা দিক থেকে ব্রাত্য, বঞ্চিত, তাঁরা শত অসুবিধে সহ্য করেও কি শহরের সর্বসম্মতির জায়গায় যোগ দেন না? পাতালরেলের স্টেশনে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই জঞ্জাল-সংযম দেখান। বানাননীতির বেলাতেও হয়তো তাঁদের সহযোগিতা দেখা যাবে, যদি শিক্ষিত নাগরিকরা প্রথমে নিজেদের উঠোনটুকু ঝাঁট দিয়ে পথ দেখান। বরং সর্বত্র নির্ভুল বানান লেখার অভ্যাস করলে শিক্ষা-বঞ্চিতদের লাভই বেশি। বেশির ভাগ বিজ্ঞপ্তিতে যদি ঠিক বানান লেখা হয়, তা হলে সমস্ত দোকানদারের চোখের অভ্যেস ঠিক হয়ে যাবে সেগুলো দেখে। ক্রমশ সবাই যা-হোক-একটা-কিছু লিখে টাঙিয়ে দেওয়া বন্ধ করবেন। বিজ্ঞপ্তির বয়ান কাউকে দেখিয়ে, বানান ঠিক করে নিয়ে টাঙানোই যে ভাল, এই ভাবনাটা ছড়িয়ে যাবে।

অন্যকে দেখিয়ে নেওয়াটা এমন কিছু উদ্ভট কথা নয়। যিনি ব্যাঙ্কের ফর্ম ভরতে জানেন না, নিরক্ষর বলে অথবা বিশেষ কোনও নিয়মকানুন জানেন না বলে, তিনি কি অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহায্য চেয়ে নেন না? কাউকে কি বলতে দেখেছেন, “সাহায্য চাইবার কোনও দরকার নেই। ব্যাঙ্কের ফর্মে যেমন ইচ্ছে আঁকিবুকি কাটলেই হল, ব্যাঙ্কের কর্মীরা সামলে নেবেন?” রাস্তায়-ঘাটে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বেলায় তা হলে কেন যথেচ্ছলিখনের সংস্কৃতি সকলের গা-সওয়া হয়ে থাকবে চির কাল?

যে দেশের পথেঘাটে লিখিত ভাষার প্রতি উপেক্ষার ছড়াছড়ি, সেখানে আমরা সকলেই পরস্পরের মনোবল কমিয়ে দিচ্ছি প্রতি মুহূর্তে। দেশবাসীর সমবেত, সামূহিক আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে যদি আমরা টের পাই সকলেই পরস্পরের দরকার নিয়ে খানিকটা সজাগ থাকছি। প্রকাশ্য জায়গায় লিখিত বিজ্ঞপ্তির বানান নিয়ে ন্যূনতম সচেতনতা ওই পারস্পরিক মনোবলবৃদ্ধির একটা সহজলভ্য জায়গা বলেই এ দিকে নজর টানছি। দৃষ্টিকটু হট্টগোল বন্ধ করা, একটুখানি যত্নের আবহ চালু করা, খুব শক্ত কাজ নয়।

যে সব দেশে নাগরিকের আত্মবিশ্বাস বেশি, সেখানে প্রকাশ্য পরিসরের বিজ্ঞপ্তি লেখা হয় যত্ন করে। আমাদের গায়ে যে পরস্পরের অযত্নের এতটা ছোঁয়াচ লাগে, সেটা আমরা এই জীবাণুগুলোকে আদর করে রেখে দিচ্ছি বলেই। নিজেদের এই অপমান করবার অভ্যেসটা সে দিনই বন্ধ হবে, যে দিন একে অসম্মান বলে স্বীকার করব।

এখানে আরও একটা ভুল বোঝার জায়গা খেয়াল করিয়ে দেওয়া ভাল। অনেকে ইউরোপ-আমেরিকা বলে একটা ‘স্টিরিয়োটাইপ’-এ আটকে যান। ওখানে বানানের প্রতি যত্নের পাশাপাশি রাস্তা পার হওয়া, গাড়ি চালানো, এই সব ব্যাপারেও নিয়মানুবর্তিতার অভ্যেস দেখতে পান। সেই গোটা ব্যাপারটাকে তাঁরা সামগ্রিক ভাবে ‘শৃঙ্খলা’ বলেন। কিন্তু ইউরোপের অন্তর্গত হেরফেরের দিকে একটু নজর দিন। হাঙ্গেরিতে অনেক বেশি লোক যেখানে খুশি রাস্তা পার হন, আর অনেক বেশি জেব্রা-সচেতন নেদারল্যান্ডস-এর নাগরিকরা। কিন্তু নেদারল্যান্ডস-এর মতোই হাঙ্গেরিতেও প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তির বানানে কেউ পান থেকে চুন খসতে দেন না। কাল্পনিক কোনও সামগ্রিক শৃঙ্খলার দিকে এগোতে চেষ্টা করার মতো দম কোনও সমাজের নেই। ধাপে ধাপে চেষ্টা করতে হয়।

যে বানান নিয়ে বিতর্ক নেই, অন্তত সেগুলোকে নির্ভুল রাখার চেষ্টা করা যাক না। ভুল বানানের বিষবৃক্ষটাকে সমূলে উৎপাটন করলে দেখা যাবে, সামাজিক আত্মবিশ্বাসের অমৃতফল ফলতে দেরি হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Spelling Language
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE