Advertisement
E-Paper

সন্ত্রাসের অবসান ঘটানোর জন্য কী করা দরকার

সিরিয়া, প্যারিস, মুম্বই— পুবের দেশ হোক বা পশ্চিমের, স্থান, কাল, পাত্র ভিন্ন কিন্তু ফল এক। জঙ্গিদের হাতে নিরীহ মানুষের জীবন খোলামকুচির মতো এক পলকেই নিঃশেষ।

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৯ ০০:০১

অতর্কিত গুলি। মৃত্যুর বিভীষিকা। বাতাসে বারুদের উল্লাস। সবাই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছে। চোখেমুখে অজানা আতঙ্ক। চারিদিকে শুধু আর্তনাদ। চাই নিরাপদ আশ্রয়। এ দিক ও দিকে লুটিয়ে পড়ে আছে ৪৯টি নিথর দেহ। শুক্রবারের নমাজের সময়ে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদের ঘটনা। আতঙ্কের ১৭ মিনিট। কিছু দিন আগেই ভারতে পুলওয়ামায় গাড়িবোমায় নিহত হয়েছেন ৪৮ জন সেন্ট্রাল রিজ়ার্ভ পুলিশ ফোর্সের সৈন্য। ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল তাঁদের দেহ।— পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই ভিন্ন ঘটনা, কিন্তু এদের মধ্যে যোগসূত্র একটাই। সন্ত্রাসবাদ। এমন একটা শব্দ যার সঙ্গে দুগ্ধপোষ্য শিশুও আজ পরিচিত। পাড়ার চায়ের দোকান হোক কিংবা বৈকালিক বৈঠকি আড্ডা, সর্বত্রই আড়ি পাতলে শোনা যায় সন্ত্রাসবাদ নিয়ে নানান আলোচনা।

সিরিয়া, প্যারিস, মুম্বই— পুবের দেশ হোক বা পশ্চিমের, স্থান, কাল, পাত্র ভিন্ন কিন্তু ফল এক। জঙ্গিদের হাতে নিরীহ মানুষের জীবন খোলামকুচির মতো এক পলকেই নিঃশেষ। আজ এখানে বিস্ফোরণে এত জন মরেছে তো কাল ওখানে এত জন। কানে আসে ঠিকই, হয়তো কারও কারও মাথাতেও ঢোকে, কিন্তু দিনের পর দিন একই ঘটনা বারংবার ঘটে চলেছে বিশ্ব জুড়ে, এর কোনও সমাধান হয় না, তাই ব্যাপারটা যেন আমাদের গা-সওয়া করে নেওয়া ছাড়া আর উপায়ও নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৮ সালে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন এমন ঘটনা ৪টি। ২০১৯ সালে ইতিমধ্যেই এ রকম ঘটনার

সংখ্যা দুই। আর বিশ্বব্যপী প্রতিনিয়ত দু’দশ জন মানুষ সন্ত্রাসবাদের শিকার হচ্ছেন এমন ঘটনার তো ইয়ত্তা নেই।

বিশ্ব এখন ক্ষুধা, দারিদ্র, অপুষ্টি, নিরক্ষরতা, জনবিস্ফোরণ ইত্যাদি নানান সমস্যায় জর্জরিত। তবুও সব কিছুর আলোচনাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদ। টেররিজ়ম শব্দটির উদ্ভব হয় ফ্রান্সে ১৭৮৯-১৭৯৯ সালে, ফরাসি বিপ্লব চলাকালীন সময়ে। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী কথাটার মানে— 'The unlawful use of violence and intimidation, especially against civilians, in the pursuit of political aims.' অর্থাৎ কোনও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করার জন্য হুমকি বা হিংসাত্মক কাজের দ্বারা বিশেষত সাধারণ জনসাধারণের উপর বলপ্রয়োগ করা। আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, উদ্দেশ্য পূরণের জন্য হিংসাত্মক কাজের দ্বারা সরকার ও জনগণের মধ্যে ভয় বা ত্রাসের সৃষ্টি করা। সন্ত্রাসবাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনায় আখ্যায়িত হয়েছে। কখনও সাইবার সন্ত্রাস, তো কখনও যৌন সন্ত্রাস। ফলে প্রতি দিন সন্ত্রাসবাদের ধারণায় নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েই চলেছে। সন্ত্রাসবাদ শব্দটি ক্রমশই আরও বেশি জটিল হয়ে উঠছে। তাতে অভিধানগত অসুবিধার সৃষ্টি হলেও আমরা বাস্তবে শব্দটির বহুমাত্রিকতাকে জেনে ফেলেছি। সন্ত্রাসবাদ প্রধানত দু’ধরনের মুখোশ পরে থাকে— রাজনৈতিক আর ধর্মীয়। কেউ ধর্মীয় উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সন্ত্রাসের আড়ালে তার গোপন কদর্য ষড়যন্ত্রগুলিকে রূপদান করে, তো কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সন্ত্রাসবাদকে আশ্রয় দেয়। কাশ্মীরে দেশের সীমান্তে প্রতি ১০০ মিটার অন্তর জওয়ানরা পাহারা দিচ্ছেন। বেচারা জওয়ান, তিনি জানেনও না সন্ত্রাসবাদী কোন অন্ধকার গর্তে বসে তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা তৈরি করছে। আর দেশের ভেতরে আমরা নকুলদানা খেয়ে উত্তেজিত হয়ে কখনও আখলাককে, কখনও অন্য কাউকে পিটিয়ে মারছি। এগুলো কি সামাজিক ভাবে, মনস্তাত্ত্বিক ভাবে আমাদের পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না?

এখনও মানুষের ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার করে মসনদে বসার নীল নকশা তৈরি করা হয়। ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতার মসনদকে ঝুঁকিহীন রাখতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ভৌগোলিক সমস্যাকে কৃত্রিম ভাবে ধর্মীয় সমস্যায় পরিণত করা হয়। মানুষের মনে সূক্ষ্ম ভাবে জঙ্গিয়ানার বীজ বপন করা হয়। উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা সব সময়ই সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকর। তবুও সুবিধাবাদী রাজনীতিক ও কিছু কিছু ধর্মগুরুর কারণে বিশ্বের সর্বত্র উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে বোঝানো হচ্ছে, বিধর্মীদের হত্যা করে নির্মূল করতে পারাটা একটা পুণ্যের কাজ। নিয়মিত ব্রেনওয়াশের ফলে এরাই জড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রাসে। আমরা শুধু সন্ত্রাসবাদ সন্ত্রাসবাদ বলে গলা ফাটাই। অথচ সন্ত্রাসবাদকে চিরতরে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার নামে লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করি না। কখনও ভেবে দেখেছি কি, এ সবের জন্যই সন্ত্রাসবাদের আরও বৃদ্ধি হয়!

কী করে এই বিংশ শতাব্দীতেও সিরিয়া, আফগানিস্তান, নাইজ়েরিয়ার মতো দেশগুলিতে বছরের পর বছর ধরে তালিবান, আইসিস, বোকো হারামেরা টিকে থাকে? অথচ আমরা বিজ্ঞানের আশীর্বাদে আজ চাঁদ, মঙ্গলকেও ঘরের দুয়ারে এনে ফেলছি। আজ বিজ্ঞান ছাড়া মানুষের এক পা চলা সম্ভব নয়। তবু অস্বাভাবিক রকমের তীব্র গতিতে বেড়ে চলেছে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ। বিশ্বসংসার এখন এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যখন সন্ত্রাস মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আজ পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়। তাও কোথাও যেন মুঠোটা মনের আলগোছে নিজেরাই ইচ্ছে করে আলগা করে রেখেছি।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শুধুমাত্র ধর্ম ও বর্ণের কারণে অনেক মানুষ প্রতিনিয়ত বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কোনও অঞ্চলের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যখন ধর্মীয় ও বর্ণগত কারণে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তাদের মধ্যে মারাত্মক সামাজিক অসন্তোষের সৃষ্টি হয। যেটা কাজে লাগায় কিছু মতলববাজ মানুষ। সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়। কিছু কায়েমি শক্তির আগ্রাসন ব্যাপক সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়ে গোটা বিশ্বকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। বিচার বিশ্লেষণ করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। আজ দুনিয়ায় অস্ত্র আমদানিকারী দেশগুলোর তালিকার ওপর দিকে ভারত, পাকিস্তান, আরব আমিরশাহির মতো দেশের নাম। অনেক কায়েমি শক্তিই আছে যারা

সবার অলক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদকে লালন করে। আর প্রয়োজনে লোক দেখানো সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখায়।

আত্মসমীক্ষার সময় এসেছে। বিশ্ব সন্ত্রাসমুক্ত হবে, এটা সে দিনই সম্ভব যে দিন আমরা নিজেদের পরিবার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসবাদীদের শনাক্ত করতে পারব, মানুষের সামনে তাদের মুখোশ খুলে দিতে পারব, জনমত গড়ে তুলতে পারব এদের বিরুদ্ধে। সে দিন সন্ত্রাসবাদীরা জনসমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সেটাই হবে সন্ত্রাসবাদের শেষের শুরু।

Terrorism Violence Crime
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy