Advertisement
E-Paper

এনআরসি তো হল, তার পর কী

নাগরিক পঞ্জির শেষ খসড়ায় প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেও তালিকায় জায়গা পাননি। এ ছাড়া আরও অসমবাসী আছেন যাঁরা আবেদন করেননি, তাই তালিকায় নাম নেই। দুটো মেলালে সংখ্যাটা আরও বাড়বে।

দেবর্ষি দাস

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:১২

নাগরিক পঞ্জির শেষ খসড়ায় প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেও তালিকায় জায়গা পাননি। এ ছাড়া আরও অসমবাসী আছেন যাঁরা আবেদন করেননি, তাই তালিকায় নাম নেই। দুটো মেলালে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। পৃথিবীর বহু দেশের জনসংখ্যা ৪০ লক্ষের কম। তা হলে এক দেশ লোকের কী গতি হবে? বাংলাদেশ? তারা এত লোকের চাপ কেন নেবে? ওদের কাছে এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। ইতিমধ্যে ১০ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। ভারত কূটনৈতিক স্তরে চাপ তৈরি করবে না, ধরে নেওয়া যায়। যে গুটিকয়েক পড়শি দেশ আমাদের এখনও বন্ধু, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম।

দুই নম্বর রাস্তা, এনআরসি-ছুটদের ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা। গোটা রাজ্যে ছ’টা বন্দি শিবির চলছে। বিদেশি ট্রাইবুনাল যাঁদের বিদেশি বলে সাব্যস্ত করেছে, তাঁদের শিবিরে রাখা হয়। বন্দিদের মধ্যে ৭০% মুসলমান। প্রায় সবাই গরিব, শ্রমজীবী। গরিব নিরক্ষরদের নিজেদের নাগরিক প্রমাণ করার কাগজপত্র নেই, টাকা নেই। ছ’টা শিবির মিলিয়ে ন’শো লোক। ৪০ লক্ষ লোককে বন্দি করে রাখা বিরাট খরচের ব্যাপার। এই খরচের সঙ্গে যোগ করতে হবে এতগুলো লোককে অর্থনীতি থেকে বার করে দেওয়ার ‘অপরচুনিটি কস্ট’ বা ‘হারানো সুযোগ’। অর্থনীতিতে এঁদের যোগদান বন্ধ হয়ে যাবে, তার একটা মূল্য আছে। দুটো খরচ যোগ করলে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর প্রায় তেত্রিশ হাজার কোটি টাকার ধাক্কা রাজ্যের অর্থনীতিতে পড়বে। রাজ্যের মোট আয় প্রায় ১৫% কমে যাবে। মানবাধিকারের কথা যদি বাদও দিই, এই বিপুল অর্থনৈতিক খরচ বহন করার যুক্তি নেই।

তৃতীয় উপায়, ‘ওয়ার্ক পারমিট’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকোর শ্রমিকদের পারমিট দেয়। সে ছাড়পত্র থাকলে মেক্সিকান হওয়া সত্ত্বেও আইনত আমেরিকায় কাজ করা যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন আডবাণী এই সমাধানের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট তাঁদেরই দেওয়া যায়, যাঁদের একটা দেশ আছে। এনআরসি-ছুটদের ভারত ছাড়া কোনও দেশ নেই, অন্তত কাগজেকলমে নেই। দেশহীন লোককে ওয়ার্ক পারমিট কী করে দেবে সরকার?

চার নম্বর, কেউ বলছেন এনআরসি-ছুটদের নাগরিক ও অ-নাগরিকের মাঝে ধূসর জায়গাতে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। বেঁচে থাকার অধিকার পাবেন, রোজগার করতে পারবেন, কিন্তু নাগরিকের সমস্ত অধিকার থাকবে না। ভোট দিতে পারবেন না। সম্পত্তির অধিকার খর্ব হতে পারে। মায়ানমারে যেমন তিন গোত্রের নাগরিক দেখা যায়। সমস্যা হল, এনআরসি খালি অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব বাতিল করছে না, ১৯৮৭-র পরে জন্মানো ছেলেমেয়েদেরও অনাগরিক বানিয়ে দিচ্ছে। বাবা-মা অনাগরিক সাব্যস্ত হলে উত্তরপুরুষও নাগরিক হতে পারবেন না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আধানাগরিক হিসেবে থাকবেন।

এত কিছুর সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে নাগরিক পঞ্জির পদ্ধতিতে গরমিল ও পক্ষপাত আছে। গ্রামের মেয়েদের কথা ভাবুন। তাঁদের জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, বিয়ের আগে বাংলাদেশে ছিলেন না, তার কী প্রমাণ আছে? অতএব, বাপের বাড়ি থেকে নথিপত্র আনতে ছোটো। কিন্তু কী প্রমাণ দেবেন তাঁরা? অনেকেই নিরক্ষর, স্কুলে যাননি, ম্যাট্রিকের অ্যাডমিট কার্ড দাখিল করবেন কী করে? অনেক মেয়ের আঠারোর আগে বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ভোটার লিস্টে নাম ওঠেনি। সে প্রমাণও মিলবে না। বার্থ সার্টিফিকেট নেই, কেননা গরিবদের জন্ম হয় আঁতুড়ঘরে। সরকারি প্রমাণ না থাকায় মেয়েরা গাঁওবুড়াদের (পঞ্চায়েত প্রধান) দিয়ে লিখিয়ে এনেছিলেন, অমুক মেয়ে অমুকের কন্যা। সেই প্রমাণ মানা হয়নি। বহু মহিলা অ-নাগরিকের তালিকায় ঢুকে গিয়েছেন।

অমিত শাহের ভাষায় এই আধ কোটি মানুষ ‘ঘুসপেটিয়ে’— অনুপ্রবেশকারী। মানে, বাংলাদেশি মুসলমান। এই প্রচার মিথ্যে। বহু ভারতীয় নাগরিক পঞ্জির খসড়ায় জায়গা পাননি। আমারই কিছু আত্মীয়ের অর্ধেক পরিবার ঢুকেছে, অর্ধেক বাইরে। ৪০ লক্ষের মধ্যে নিঃসন্দেহে বহু হিন্দু আছেন। তাতে অবশ্য কিছু আসে-যায় না। হিন্দুত্ববাদী দল ২০১৯-এর ভোটের আগে নাগরিক পঞ্জিকে পুঁজি করে মুসলমানবিদ্বেষ ছড়াবে।

ঠিকই, স্থানীয়দের মধ্যে বিদেশি বা বহিরাগত নিয়ে উদ্বেগ আছে। কিন্তু বিদেশি শনাক্ত করতে গিয়ে নাগরিক পঞ্জি ধরে নিচ্ছে গোটা রাজ্যের লোক বেআইনি অনুপ্রবেশকারী— এ বার নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করে দেখান। ন্যাচারাল জাস্টিস বা স্বাভাবিক ন্যায়ের ধারণাকে উল্টো করে দেওয়া হচ্ছে। উচিত কাজ হল, নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে কেস রুজু করুক। আদালতে রাষ্ট্রই প্রমাণ করুক অমুক ব্যক্তি বিদেশি।

তবে কোর্টকাছারি দিয়ে সমাধান হবে না। অসম রাজনীতির গভীরে ঢুকে গিয়েছে ভূমিপুত্র-সুরক্ষার বিষয়টি। ভূমিপুত্র বনাম বহিরাগত দ্বন্দ্বের চার দিকেই রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবিকা, নেতাদের দুর্নীতি, প্রাকৃতিক সম্পদের লুটতরাজের প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। রাজনীতির বদল না হলে নতুন নতুন অবতারে নাগরিক পঞ্জি দেখা দিতে থাকবে।

আইআইটি, গুয়াহাটি-তে অর্থনীতির শিক্ষক

Assam NRC Draft
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy