Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

তা হলে মহিলা থানা চালু করে লাভ কী হল?

মেয়েরা যাতে মন খুলে সব কথা বলতে পারে সেই কারণেই এই থানার সমস্ত কর্মী মহিলা। সেখান থেকে মেয়েদের ফিরিয়ে দিলে পুরো ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামভারতে মহিলাদের উপরে অপরাধের যত ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের রাশ টানতে ডব্লিউপিএস বা মহিলা থানা চালু হয়।

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৯ ০২:২৮
Share: Save:

মানুষ বিপন্ন হলেই বিচার চাইবে। নিয়ম মেনে থানায় যাবে। কিন্তু বাস্তবে থানা অভিযোগকারীকে অপেক্ষা করাবে বা ফেরাবে। এমন বহু নজির রয়েছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক বলে মানুষ মেনে নিতে শিখেছে। অপরাধীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে অভিযোগকারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়। তাই ‘বিশেষ কনট্যাক্ট’ না থাকলে কাজ হবে না। কিন্তু দেশ রক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার সময় অপরাধ রোধ, অপরাধ উন্মোচনের শপথ ছিল পুলিশের। পুলিশের একাংশ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার ‘সিস্টেম’ গড়েছে সম্পূর্ণ ব্যক্তিসুবিধার প্রয়োজনে। ভাবতে অবাক লাগে এক জন মেধাসম্পন্ন মানুষ চাকরিতে বদলি চান না। পুরস্কৃত হতে চান। শুধু তাই নিজের দায়িত্ব পালন করেন না। শাসকের ধামা ধরার কাজে পুরো দফতরকে বিলিয়ে দিয়ে থাকেন। নিজেদের মেয়াদ শেষ করে তাঁরা বিদায় নিচ্ছেন এলাকা থেকে। আর সেই সঙ্গে বদলে দিয়ে যাচ্ছেন একটা থানার চরিত্র। তাই মুখে মুখে শোনা যায়, ‘রেপ কেসে এফআইআর করতে যাওয়া বেশ চাপের’।

এই চাপ থেকে জনগণকে মুক্তি দেওয়ার দায় সরকারের। আর সেই কারণেই মহিলা পুলিশ থানা। কিন্তু সেই থানা কি কারও অধীনতায় বশ মেনে থেকে গিয়েছে? স্বাধীন সিদ্ধান্ত কি সেই থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক নিতে পারেন না? তাঁদের উপরেও কি কোনও অনুমোদনহীন দায়িত্বের ভার আছে? কেস নথিভুক্তির বদলে অত্যাচারিত মেয়েপক্ষকে ‘বুঝিয়ে বাড়ি পাঠানো’র অতিরিক্ত কর্তব্য কি তাঁরাও গোপনে পালন করছেন? যদিও কিছু ক্ষেত্রে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রাখা সরকারের দরকার। তবে সেই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক হাতিয়ার হওয়া দরকার নির্বাচন। বোঝা জরুরি, মেয়েদের সুরক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার নিজের পরিবার। এবং আগামীর আরও একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ। সমাজের সার্বিক স্বার্থ রক্ষার্থেই প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা। তাই সাংবিধানিক দায়ের বাইরেও এটা একটা সামাজিক ও পারিবারিক দায়। জনগণের সমস্বরের কাছে আইনি সব রকম শিথিলতা পরাস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে কই?

ভারতে মহিলাদের উপরে অপরাধের যত ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের রাশ টানতে ডব্লিউপিএস বা মহিলা থানা চালু হয়। মেয়েরা যাতে মন খুলে সব কথা বলতে পারে সেই কারণেই এই থানার আইসি থেকে অন্য সমস্ত কর্মীই মহিলা। সেখানে মেয়েদের কথা না শুনে তাদের ফিরিয়ে দিলে পুরো ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। মহিলাদের চলার পথ জটিল, কঠিন ও দীর্ঘ। যে সব সমস্যা তাদের সামনে আসে তা বেশিরভাগ প্রথাগত ভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিধি নিষেধের গণ্ডী মেনে পুরুষদের নির্মাণ। বিজ্ঞান ও যুক্তির চেয়ে দমন বা অবরোধের মানদণ্ডে ছেঁকে তোলা সেই ধারাবাহিক বিচারধারা। তাতে মান্যতা দেওয়ার বাইরে মেয়েদের আলাদা কোনও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। যে মূল বিষয় তাদের ব্যক্তিগত ভাবে আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেয় তা হল হিংসার তীব্রতা। নিজেদের অধিকার বিষয়ক অজ্ঞতা, বিবাহ নিয়ে আবেগ ও আদর্শবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস তাদেরকে বহু সময় অপরাধীকে চিহ্নিত ও শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতার ভূমিকা নেয়। ঘরছাড়া হওয়ার ভয়, পারিবারিক কোনও বিপদের আশঙ্কা বা সন্তানের ক্ষতি হয়ে যাওয়া ও শারীরিক নিরাপত্তাবোধের অভাব থেকেই মেয়েরা চুপ করে থাকে। তাদের এই নীরবতা ভেঙে সমস্যাকে বেশি করে গুরুত্ব দিতেই মহিলা থানার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এবং হচ্ছে।

লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে মহিলা পুলিশ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে সমীক্ষা করে। মেয়েদের তাদের অধিকার ও আইনি ধারা নিয়ে সচেতন করে। নিকারাগুয়া, ইকুয়েডেটরে যখন প্রথম বার মহিলারা থানায় প্রবেশ করে তখন তাদের আইনি পরিষেবা ও অধিকার নিয়ে সচেতন করা হয় মহিলা থানার তরফ থেকে। মহিলাদের সমস্যার কথা মন দিয়ে শোনা হয়। সাহস জোগানো হয়। মাঝে মাঝে যাতে তারা থানায় আসতে পারে কোনও বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য সেই পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া হয়। সহিংসতার বিরুদ্ধে নিন্দা করার এক গণঅভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টাই থাকে মুখ্য। সহিংসতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মেয়েরা সমর্থিত হচ্ছে ও তাদের সমস্যা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, সেটা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে মহিলা পুলিশদের সচেতন ভূমিকা থাকে। বিপর্যয়ের মুখে পড়া মেয়েদের বিচার পাওয়ার সুযোগ তৈরি ও আস্থা অর্জন করানোই মহিলা থানার প্রাথমিক কাজ। নিয়মমাফিক সমস্যার বিবরণী নথিভুক্ত করার জন্য ভিক্টিমদের উৎসাহিত করার ক্ষেত্রেও মহিলা থানার বিরাট ভূমিকা।

রঘুনাথগঞ্জের নির্যাতিতার এইআইআর দায়ের হয়েছে ১৭ দিন পরে। মেডিক্যাল পরীক্ষা হয়েছে তারও পরে। প্রশাসনের এমন দায়সারা পদক্ষেপের কারণ কী? জনগণকে থামিয়ে দেওয়া? ভুল বোঝানো? পরিস্থিতি সামাল দেওয়া নাকি মানুষকে পরিষেবা দেওয়া— কোনটি প্রথম? প্রমাণের চিহ্ন নিয়ে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন? কতক্ষণ থাকে ধর্ষকের রেখে যাওয়া প্রমাণ? ফরেনসিক পরীক্ষার একটি অন্যতম অঙ্গ এখন ‘ডিএনএ প্রোফাইলিং’। সে ব্যবস্থা সরকারি হাসপাতালে নেই। ধর্ষণের পরে যে কোনও বায়োলজিক্যাল মেটেরিয়াল বলে দিতে পারে অপরাধীর পরিচয়। তাই স্নান করা, বাথরুমে যাওয়া, জামা-কাপড় ছেডে ফেলা, চুল আঁচড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আপাত-অমূল্য এই সব প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এই বিষয়ক অভিযোগের নির্ণায়ক পরীক্ষা করার জন্য সাধারণ ভাবে থাকে ‘রেপ কিট’। সরকারি হাসপাতালে অন্য দেশগুলির মতো উন্নতমানের এই কিট নেই। যদি অপরাধ ৪৮ ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি পেরিয়ে গিয়ে থাকে তবে নমুনা সংগ্রহ চিকিৎসকের হাতের বাইরে চলে যেতে থাকে। সেখানে পেরিয়ে গিয়েছে কয়েকশো ঘণ্টা। তা হলে এ ক্ষেত্রে কী হবে?

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE