Advertisement
E-Paper

বাড়ির ডাক্তাররা কি ফিরবেন

পুরনো ব্যবস্থা নতুন করে ফিরে আসে, নতুন রূপ রস আর গন্ধ নিয়ে। তখন আর তাকে পুরনো বলে চেনা যায় না। কারণ, আমাদের অগ্রগতির অভিমুখ চক্রাকার না, তা সর্পিল। তাই যাকে পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয় তা আসলে নতুন।

স্থবির দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০

কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল! আমাদের জনজীবনে এক একটা অঞ্চল ছিল, পাড়া ছিল। ঘন কোলাহলে পাড়াগুলো জীবন্ত থাকত; তারই আঁচ এসে পড়ত পরিবারে। পরিবার ছিল, গৃহ ছিল, যে গৃহ ছায়া দিত, স্বস্তি দিত। ‘তে হি নো দিবসাঃ গতাঃ’। প্রশ্রয়-প্রবণ পরিবারগুলিকে আমরা ধ্বংস করেছি। কেন যে অমন করতে গেলাম তার তত্ত্ববিশ্লেষণ শুনে মনে হয়, আধুনিকতার অমোঘ টানে আমরা সব কিছু ভাঙতে চেয়েছিলাম। তাকে বিজ্ঞানমনস্কতা ভেবে আত্মতৃপ্তিও পাওয়া গিয়েছে, অথচ সেই মনে বিজ্ঞানের ঠাঁই নেই। বাড়ি ভেঙে যা পেলাম তার নাম দিলাম ‘ইউনিট ফ্যামিলি’। আর, উদ্ভাবনের প্রাথমিক উল্লাস কাটিয়ে, ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম, এ তো কঙ্কাল, এ তো আমরা চাইনি!

তত দিনে আলাদিনের দৈত্য ঘরে ঢুকে পড়েছে। একটা সময় শুনেছিলাম, এগিয়ে চলা মানেই উন্নতি, দেহ মন আর জীবনযাপনের উন্নয়ন। তার জন্য নাকি আছে আশ্চর্য প্রদীপ, জ্বালালেই কিস্তি মাত। সেই লোভেই আলাদিনের কাছে যাওয়া, প্রদীপের আলো দেখে চমৎকৃত হওয়া, বিহ্বলও। এ কথা তখন ভেবে দেখিনি যে, দৈত্য শুধু দিতেই আসে না, নিতেও আসে। আসলে নেওয়ার জন্যই তার আসা। তাই সে নিয়ে গেল গৃহ, পরিবার। এখন আমাদের পাড়া নেই, বাড়ি নেই, তাই ‘পাড়ার ডাক্তার’, ‘বাড়ির ডাক্তার’ নেই। যাঁরা কেবল চিকিৎসকই নন, সংসারের যাবতীয় সমস্যার মন্ত্রণাদাতা হিসেবে পরিবারেরই এক জন ছিলেন, ছন্নছাড়া জনজীবনে তাঁরা আর থাকেন কোথায়? তাই এখন উন্নয়নের মায়াকাজল পরে আমাদের মুখে হাসি, চোখে জল।

এমন কিন্তু ছিল না। শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা আজকের মতো এমন উদ্‌ভ্রান্ত, উদ্বিগ্ন ছিলাম না। কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের পথ ভুলিয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছে লোভের স্বর্গে, প্রতিবেশীর প্রতি ঈর্ষায় যে বাগানে গাছে গাছে ব্যক্তিস্বার্থের মহিমা। আর সরকারের অপার উদাসীনতা আমাদেরকে উদ্‌ভ্রান্ত করেছে। এই পাপ সে ঢাকবে কী দিয়ে? হিসেব বলছে, প্রতি বছর আমাদের দেশে যত স্নাতক ডাক্তার তৈরি হচ্ছেন তাঁদের মাত্র ২৩ শতাংশ থেকে যাচ্ছেন গৃহচিকিৎসক হিসেবে। তাঁরা ‘সাধারণ’, মাথায় বিশারদের পালকগুচ্ছ নেই, তাই ‘অতি উঁচু নাক’ও নেই। ১২০ কোটির দেশ, দুর্বিষহ দুর্যোগ নিয়েও সেই সংখ্যা বাড়ে। এঁদের শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে গেলে ওই সাধারণ ডাক্তারদেরই দরকার সব চেয়ে বেশি। অথচ তাঁদের আকাল পড়েছে, শহরে তো বটেই, গ্রামেও।

এ বড় বিষম রোগ। রোগের দাওয়াই নিয়ে অনেকে অনেক উপদেশই দেন। কেউ প্রতিবেশী বা দূর দেশের পরিসংখ্যান দেখান, কেউ জনসংখ্যা আর ডাক্তারের করুণ অনুপাত দেখান। আবার কেউ প্রযুক্তির ঝলকানি দেখিয়ে বলেন, দেখো আমি বাড়ছি মামি! সব তথ্যই এমন মোক্ষম যে শিরোধার্য করা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় থাকে না। তবে তাতে প্রজ্ঞার প্লাবিত বিভাস যে থাকে না, তা বলাই বাহুল্য। ও দিকে সরকার শোনায় অগ্রগতির সুবচন। ভুলে যাই বড় বড় সুরম্য হাসপাতাল, চোখধাঁধানো ‘ক্লিনিক’ ও ডাক্তারির বিচিত্র বিদ্যায় পারদর্শীরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার বুনিয়াদ নন। বরং যাঁদেরকে ‘সাধারণ’ বলে তুচ্ছ করি, তাঁরাই এর ভিত্তি।

এ সব কথা ভুলে যাই বলে শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের উদ্‌ভ্রান্তি বাড়ে। মনের মধ্যে সারা ক্ষণ যেন মৃত্যুভয়ের হিমশীতল কুবাতাস। তাই রাস্তার হোর্ডিং দেখে দেখে উচ্চ মানের হাসপাতালে পৌঁছে যাওয়া, দেহটাকে একটু ‘ওভারহল’ করে নেওয়া। তার পর যেন নিশ্চিন্তি, অন্তত কিছু কালের জন্য। এই কুৎসিত, দাপুটে সংস্কৃতি এখন স্বাস্থ্যের সংজ্ঞাই পাল্টে ফেলেছে। ছাতি-কোমরের মাপ আর রক্তে নানান উপাদানের পরিমাপ দিয়ে সে স্বাস্থ্য রচনা করতে শেখায়। আমরা স্রেফ ভুলেই বসেছি অসুস্থ হওয়াটা অস্বাস্থ্যের লক্ষণ না; বরং ব্যাধিগ্রস্ত হওয়া আর তা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠাই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। অমন ভুলো মনে স্বাস্থ্যব্যবস্থার বুনিয়াদ গড়ে তোলার যুক্তি আর দাঁড়ায় কোথায়? তাই ‘সাধারণ’ ডাক্তার হয়ে যান বিলুপ্ত প্রজাতি, আমাদের দুর্ভোগ বাড়ে।

সব দুর্ভোগ নাকি দূর করে দেবে স্বাস্থ্যবিমা নামে কোনও এক প্রভু, আমাদের সব দীনতাও নাকি সে ক্ষমা করে দেবে। কোনও মতে সরকারকে বোঝানো যায় না যে বিমা না, স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থাটাকে নিশ্চিত করাই আমাদের দাবি, ‘ইনশিয়োরেন্স’ বা বিমা নয়, ‘অ্যাশিয়োরেন্স’ বা আশ্বাস।

বোঝাতে গিয়ে যখন কালঘাম ছুটে যায় তখন বুঝি, সরকার তো শালগ্রাম শিলার মতো, ‘শোওয়া বসা যার সকলি সমান’! তার সঙ্গে কত আর লীলাখেলা করা যায়। সে তো এখন ভাবে, স্বাস্থ্যরক্ষার নামে লোকের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেই তার পাপক্ষালন হবে। এও শুনি, পাবলিকের নাকি বড় দরকার, তাই শহরে গ্রামে থরে থরে ‘সুপার-স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতাল সাজিয়ে রাখতে হবে। এমন নিরেট নির্বুদ্ধিতা কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগেও তেমন সহজলভ্য ছিল না। সেই প্রবলসম্ভাবী যুগ বহু কাল গত।

এখন, এই নতুন যুগে তা হলে কী করা? স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে উন্নতি নিয়ে আমাদের এত গর্ব তাতে ফাঁকফোকর যথেষ্ট, কেন না প্রযুক্তির ঝর্নাধারায় মানবদেহ নিষ্কলুষ হয়ে যাবে এই ধারণাটাই গোলমেলে। তাই এই ব্যবস্থার প্রতি স্তরে গলদ; তবে তার মধ্যে বুনিয়াদি স্তরটার গুরুত্বই সব চেয়ে বেশি। যে বুনিয়াদটাকে এত কাল তুচ্ছ ভেবে উন্নয়নের পথের পাশে ফেলে রেখেছি তাকেই আবার তুলে আনতে না পারলে, শক্তপোক্ত করতে না পারলে, অস্বাস্থ্যের চোঁয়া ঢেকুর তুলেই আমাদের বাঁচতে হবে। পারিবারিক চিকিৎসকরাই সুঠাম স্বাস্থ্যব্যবস্থার রত্ন। অনেকে ভাবেন, গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থাই যদি অপবিত্র হয়ে থাকে তা হলে ওই রত্নই বা নির্ভেজাল কিসে? ঠিক, তবু পুরনো বুনিয়াদটার দিকেই নজর রাখা দরকার। নির্ভেজাল, অখণ্ডিত রত্ন কি মেলে?

পুরনো ব্যবস্থা নতুন করে ফিরে আসে, নতুন রূপ রস আর গন্ধ নিয়ে। তখন আর তাকে পুরনো বলে চেনা যায় না। কারণ, আমাদের অগ্রগতির অভিমুখ চক্রাকার না, তা সর্পিল। তাই যাকে পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয় তা আসলে নতুন। সেই নতুন ব্যবস্থার নানান হদিসের কথা আমরা শুনি। কোনটা যে ঠিক তা বুঝতে পারি না। লুই পাস্তুর বলতেন, আমার হাতে যদি এক তাল মাটি থাকে আর তাতে আমি যদি ‘অ্যানথ্রাক্স’ জাতীয় জীবাণু দেখতে পাই তা হলে তার একমাত্র কারণ এই যে ওতে ওই জীবাণুটি আছে। কিন্তু ওই একই মাটির তালে অন্য কোনও বিজ্ঞানী যদি ওই জীবাণুটি দেখতে না-পান তা হলে বুঝতে হবে, ওটা তাঁর দেখার ভুল। সত্য আবিষ্কারের পথ একটিই; অন্য পথ ধরে চললে শুধু অসত্যের সঙ্গেই দেখা হয়।

তাই মনে হয়, এই মুহূর্তে গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার অধিগ্রহণই একমাত্র পথ। শিক্ষা বা স্বাস্থ্যরক্ষার মতো জরুরি বিষয়গুলোকে বাণিজ্য-তুখড় লোকজনের হাতে ছেড়ে রাখা যায় না। আমরা যদি নিজেদেরকে সভ্য বলে দাবি করি, তা হলে এও মনে রাখতে হবে যে দুর্বল আর অক্ষমের পাশে দাঁড়ানোই সভ্যতা। এ পর্যন্ত তেমন সভ্য সরকার আমাদের কপালে জোটেনি, সত্যি। তবু যা জুটেছে সেই পাপবিদ্ধ সরকারকে এই কাজটুকু করতে বাধ্য করা দরকার। তা নইলে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় একটা সুস্থ, স্বস্তিদায়ক, গণতান্ত্রিক পরিবেশ কোনও দিনই রচিত হবে না। পাপক্ষালনের এইটুকু সুযোগ হয়তো আজও আছে। তাতে দমবন্ধ পরিবেশে কিছু দিন নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। ‘বাড়ির ডাক্তাররা’ আবার ফিরে আসবেন, নতুন পন্থায়, নতুন রূপ নিয়ে।

স্বাস্থ্যব্যবস্থা অধিগ্রহণ করে ফেললেই সব সমস্যা তলিয়ে যাবে তা না। সেটা শুধু প্রাথমিক পদক্ষেপ। তার পর আছে আরও বহু কাজ, নতুন বিরোধের নতুন সমাধান উদ্ভাবনের কাজ। বাতিল করে যা পাব তাকে তো আবার নতুন করে বাতিল করতে হবে। কিছু কি আর থেমে থাকে? এই খ্যাতিহীন, ছন্নছাড়া জীবনযাপনে সেই আত্মানুসন্ধানের দাবি কি খুব অসঙ্গত হবে?

Health House Physician Editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy