Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কাশ্মীর থেকে নাগরিক পঞ্জি: কেন লাগাতার ভীতি প্রদর্শন?

যে মানুষেরা কোনও দিন মহকুমা আদালতে যাননি, রাষ্ট্র কি আশা করে সেই মানুষেরা উচ্চ আদালত কিংবা সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে আবেদন করবেন? লিখছেন সুমন সেনগুপ্ত এই মুহূর্তে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে। জিডিপি বাড়ার হার পাঁচ শতাংশে এসে ঠেকেছে।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:২১
Share: Save:

এক মাস পেরিয়ে গেল, কাশ্মীর অবরুদ্ধ হয়ে আছে। ইদ কেটে গিয়ে মহরমেও এখন উপত্যকাতে শুধু ভারী বুটের শব্দ। এখন তো নতুন খবর সামনে চলে এসেছে। অসমে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন হল, বা বলা ভাল দেশহীন হল। কারও পিতামাতার সঙ্গে সন্তানদের বিচ্ছেদ হয়েছে, কারও স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর। এই রকম বহু খবর এই মুহূর্তে সামনের পাতায় চলে এসেছে। সমস্ত নাগরিকদের মধ্যে একটা ভীতি বা ভয়ের আবহাওয়া তৈরি করে দেওয়া গিয়েছে। অনেকেই এই বিষয়ে নিজেদের কাগজপত্র জোগাড় করার দিকে মন দিয়েছেন। বলা ভাল, বাধ্য হয়েছেন। এই ভয়টা ধীরে ধীরে সবার মধ্যে প্রবেশ করছে। চারদিক থেকে বিভিন্ন খবর আসছে, প্রায় ৫০ শতাংশ হিন্দু বাদ গিয়েছেন, আবার কখনও খবর আসছে প্রচুর গোর্খা মানুষ আছেন বাদের তালিকায়।

এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যে, তারা নির্বাচক তালিকা পরীক্ষা করবে। অন্য একটি ডকুমেন্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে আদৌ সেই ভোটারের অস্তিত্ব আছে নাকি। অনেকে বলছেন যে, এটাও নাকি ডি-ভোটার বা ডাউটফুল ভোটার খোঁজার প্রক্রিয়া। সেই নিয়ে নাগরিকপঞ্জিকে জড়িয়ে আবারও নাগরিক মনে ভয় ঢোকাতে শুরু করেছে কেন্দ্রের শাসক দল। কেন এই ভয় দেখানো?

এই মুহূর্তে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে। জিডিপি বাড়ার হার পাঁচ শতাংশে এসে ঠেকেছে। গাড়ি-শিল্প তলানিতে। রেলে কর্মী সঙ্কোচনের খবর আসছে। অর্থমন্ত্রী ২৭টি ব্যাঙ্ককে সংযোগ করে ১২টি ব্যাঙ্কে নিয়ে আসার কথা বলেছেন। যদিও তিনি বলেছেন যে এর ফলে কারও চাকরি যাবে না, তবুও মানুষ আশঙ্কায় আছেন। চারদিক থেকে ছোটখাট ব্যবসা বন্ধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সবাই অত্যন্ত ভয়ে আছেন— এই বুঝি পিঙ্ক স্লিপ এল। রাস্তাঘাটে কথা ভেসে আসছে কী যে দিন আসতে চলেছে, কে জানে! ঘটনাচক্রে এই মানুষের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। এই মানুষেরা কোথাও কোথাও একজোট হচ্ছেন, সেই খবরও আসছে। সুতরাং, শাসকশ্রেণিও নিজে আতঙ্কিত। তাঁরাও ভয় পাচ্ছেন যদি এই মানুষেরা একজোট হতে শুরু করেন তা হলে অন্য কোনও সঙ্কেত বা বার্তা দিতে পারে, যা শাসকশ্রেণির জন্য মোটেও সুখকর হবে কি? সেই জন্যই কি তাঁরা এই ভয়টা জারিয়ে রাখতে চাইছেন নাগরিকদের মধ্যে?

এই ভয়ের সূত্রপাত কবে?

যদি খেয়াল করা যায়, এই ভয় কিন্তু এক দিনে আনা হয়নি। সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে একটা বিদ্বেষের বিষ এই সরকার ২০১৪ সালে যখন এসেছিল, তখন থেকেই ঢোকানো হয়েছিল। যাতে সমাজের এক অংশের মানুষ অন্য অংশের মানুষকে ভয় পায়। মাথা নিচু করে থাকে। তার পর সেই ভয়টা এক দিন রাত ৮টার সময়ে সমাজের সবার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বলা হল, সমস্ত প্রচলিত নোটকে বাতিল করে দেওয়া হল। এটার মধ্যেও কিন্তু এক ধরনের হিংসা এবং বিদ্বেষ ছিল। সমাজের এক অংশের মানুষের মধ্যে একটা ধারণা ছিলই যে তাঁর প্রতিবেশী হয়তো বা কালো টাকার মালিক। ঠিক সেই জায়গাটা দিয়েই ঢুকে পড়ল শাসক দল। এর পরের ভয় দেখানো শুরু হল আধার সংযোগ নিয়ে, যদি কোনও ব্যক্তি তাঁর আধারের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট যুক্ত না করেন, তা হলে তাঁর ব্যাঙ্কের টাকা সব আটকে যাবে কিংবা গ্যাসের সাবসিডি বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ, যে ন্যূনতম ভর্তুকি পাওয়ার জন্য মানুষ তাঁদের দৈনন্দিন সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধারকে যুক্ত করলেন, সেই ভর্তুকিই দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার ১০০ দিনের মধ্যে তুলে দিল এই সরকার। তার পর এল জিএসটি, যা ছোট ছোট ব্যবসাকে আরও ভয় দেখানোর জন্যই আনা হয়েছে বলে অনেকে বলে থাকেন। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে শুধু ভয় দেখানোর জন্যই মানুষকে বিভিন্ন ভাবে ব্যস্ত রাখতে চায় এই সরকার। যার শেষতম সংযোজন এই ভোটার তালিকা এবং নাগরিকপঞ্জি দিয়ে মানুষকে ব্যস্ত রাখা।

মানুষ যদি নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকেন, তা হলে তাঁরা আর নিজেরা ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারবেন না। তা হলে তাঁরা আর একজোট হয়ে শাসকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারবেন না।

প্রতিটি নাগরিকের এক জনকে অন্য জনের থেকে আলাদা রাখো— এই হচ্ছে কৌশল। তা হলে আর তাঁরা শাসকের দিকে আঙুল তুলতে পারবেন না। তাঁরা আর প্রশ্ন তুলতে পারবেন না কেন ভারতে ১ শতাংশ মানুষের হাতে ৭৩ শতাংশ সম্পত্তি? কেন ব্যাঙ্কে অনাদায়ী ঋণের বোঝার দায় ভারতের সাধারণ নাগরিকেরা নেবেন? কোনও মানুষ যাতে পাশের মানুষের সঙ্গে ঐক্যমত্যে এসে একযোগে কথা না বলতে পারেন, সেই জন্যই এই আধার নিয়ে ব্যস্ত করে রাখা। সেই জন্যই নাগরিকপঞ্জির জন্য তথ্য জোগাড় করানোর মাধ্যমে মানুষকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা।

অসমের নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর এই বাংলায় বিভিন্ন জায়গায় রীতিমতো আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও শুধু মুসলমান মানুষেরা এই নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ যাননি। প্রচুর হিন্দু মানুষেরাও বাদ গিয়েছেন, তা সত্ত্বেও এই বাংলার ইমামদের তরফ থেকে রীতিমতো ছাপিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে কী কী তথ্য এক জন মানুষকে সংগ্রহে রাখতে হবে।

তার পরেও কি বলা যাবে বাংলায় এই নাগরিকপঞ্জি যদি হয়, কোনও মানুষ সেখান থেকে বাদ পড়বেন না? যেখানে অসমকে উদাহরণ হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, সেখানকার ১৯ লক্ষ মানুষ তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, এর পর তাঁদেরকে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করতে হবে। এখনও অবধি যা ঠিক আছে ১০০-র উপর এই ধরনের ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা হয়েছে।

কিন্তু রোজ ১০০ জন মানুষও যদি ওই ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন তা হলেও মোট কত দিন লাগতে পারে, এটা আন্দাজ করা কি কঠিন কাজ? যে মানুষেরা কোনও দিন মহকুমা আদালতে যাননি, রাষ্ট্র কি আশা করে সেই মানুষেরা উচ্চ আদালত কিংবা সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে আবেদন করবেন? খবর আসছে যে যাঁরা এই ট্রাইব্যুনালে কাজ করবেন, তাঁরা কিন্তু বিধানসভার দ্বারা নির্বাচিত নন। তাঁদেরকে সরকার নির্বাচন করেছেন এবং প্রত্যেকেরই কাজের মেয়াদ এক বছর, যা বাড়তে পারে সরকার চাইলে। তা হলে কি ওই আধিকারিকেরা কখনওই চাইবেন সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করতে?

শাসক কি কাউকে আলাদা করবে?

এখন চারদিকে নতুন কলরব। ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার, শোনা যাচ্ছে যে ২০২১ সালের সেনসাস বা জনগণনার জন্য নাকি এটার প্রয়োজন। যদি মনে করা যায় এই একই রকম তথ্য নেওয়া শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে, তার পর সেখান থেকে নাগরিকদের আধারে নথিভুক্ত করার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এবারও কি তবে এখান থেকে নাগরিকপঞ্জির কাজটা শুরু হবে?

বলা যাচ্ছে না কিছুই। অসমের এতগুলি মানুষ বাদ যাওয়ার পর শাসকদল মনে হয় আর ঘোষণা করে নাগরিকপঞ্জির কাজ করবে না। তবে মানুষকে ভীত রাখার কাজটা কিন্তু চলতেই থাকবে। কারণ শাসক এটা জানে, মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত থাকলে মৌলিক প্রশ্ন করতে পারবে না। তাই আমরা নাগরিকেরা কেমন যেন শান্ত হয়ে আছি। আমরা কেমন যেন একটা নেশায় বুঁদ হয়ে আছি। কখনও সেটা চন্দ্রযান-২ চাঁদের মাটি ছুঁল কি না, কখনও প্রধানমন্ত্রীর ইসরো প্রধানের কাঁধ চাপড়ানো, কখনও প্লাস্টিক বর্জনে মোদীর আত্মমূলক প্রচার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকছি।

দেশের নানা জায়গা থেকে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির খবর আসলেও আমাদের কোনও কিছুতেই আর কিছু যায় আসছে না। উগ্র হিন্দুত্ববাদের দীর্ঘ দিনের লালন করা একটা স্বপ্ন যে এই দেশ মুসলমান মুক্ত হবে! হ্যাঁ, সেই জন্যই নাগরিকপঞ্জিতে হিন্দুরা বাদ গেলেও আমাদের মাথার মধ্যে কোথাও এমন একটা ধারণা কাজ করছে এখনকার শাসকদল সংখ্যাগুরুর কথা নিশ্চিত মাথায় রাখবে। তাই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনা হবে।

কিন্তু শাসক তো শাসকই। সে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু আলাদা করে না— আমরা কি এটা ভুলে যাব? তা সে কারখানা বন্ধ করার ক্ষেত্রে হোক আর নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়ার ক্ষেত্রে হোক— মানুষকে ছেঁটে ফেলার ক্ষেত্রে শাসক কখনও পরোয়া করে না। পূর্ব অভিজ্ঞতা কী বলে?

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jammu And Kashmir Article 370 Assam NRC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE