স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় যাঁহার গুণকীর্তন করেন, তাঁহার সামাজিক প্রতিপত্তির মাপ লইয়া সংশয় থাকে না। গুরমিত রাম রহিম বাবাজি সেই বিরল প্রতিপত্তিশালীদের মধ্যেও বিরলতর। তাঁহার ভক্তসংখ্যা নাকি প্রায় ছয় কোটি। এহেন বাবাজিকে কুড়ি বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিল বিশেষ সিবিআই আদালত। ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ইহা এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। সরকার এবং প্রশাসন যে প্রতিপত্তিশালীদের রক্ষা করিতে কত দূর সক্রিয় হইতে পারে, তাহার উদাহরণ কার্যত না খুঁজিতেই মেলে। রাম রহিমের মামলাটি সেই উদাহরণের তালিকায় উপরের দিকেই থাকিবে। শুধু মনোহরলাল খট্টার নহেন, তাঁহার পূর্বসূরি কংগ্রেসের ভূপেন্দ্র সিংহ হুডা এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোক দলের ওমপ্রকাশ চৌটালা, সকলের বিরুদ্ধেই বাবাজির অপরাধ আ়়ড়াল করিবার অভিযোগ রহিয়াছে। তবুও যে ন্যায়বিচার সম্ভব, আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের ওপর মানুষ যে ভরসা হারাইয়াছে, বিচারবিভাগ তাহার মর্যাদা রক্ষা করিতে পারে, এই কথাটি বিশেষ সিবিআই আদালতের রায়ে আরও এক বার প্রতিষ্ঠিত হইল। ভারতীয় গণতন্ত্রের নিকট এই আশ্বাসটি অতি জরুরি ছিল। স্বাধীন ভারতের নিকট এমন মুহূর্ত খুব কম, যখন সাধারণ মানুষের মনে রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস আজিকার ন্যায় এমন তলানিতে ঠেকিয়াছিল।
রাম রহিমের সমর্থকদের কেন পঞ্চকুলায় জমায়েত করিতে দেওয়া হইল, সেই প্রশ্নের উত্তরে রাজনাথ সিংহ জানাইয়াছিলেন, ইহাই গণতন্ত্র। প্রসঙ্গত, রাজনাথ সিংহই তিনি, যাঁহার তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি জনসভায় কিছু স্লোগান দেওয়ার অভিযোগে কানহাইয়া কুমারদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়। ‘গণতন্ত্র’ বস্তুটি যে তাঁহাদের নিকট নিছকই পরিহাসের, হাসি-তামাশার বিষয়, তাহা বুঝাইয়া দিতে দেশের বর্তমান শাসকরা কসুর করেন নাই। তাঁহারা জানেন, দলের রাজ্য সভাপতির পুত্রের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ উঠিলে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ অমিল হওয়াই দস্তুর। ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে নড়িয়া বসিতে বাধ্য করিতে হইলে প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিক্ষোভের ঝড় বহাইতে হয়, গণমাধ্যমে হইচই ফেলিতে হয়। তাহার পরও যে সব ক্ষেত্রে কাজ হয় না। রাষ্ট্রের নিকট ন্যায় পাওয়া সম্ভব, এ কথা মানুষ ভুলিতে বসিয়াছে।
আদালত রাম রহিমকে ‘বন্য পশু’-র সহিত তুলনা করিয়াছে। তিরস্কারটি শুধু এই ধর্ষকের প্রতিই, ভাবিলে খণ্ডদর্শন হইবে। সমাজের পক্ষে এতখানি বিপজ্জনক এহেন একটি পদার্থ ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হইবার পরেও দেড় দশক কী ভাবে আইনের নাগালের বাহিরে থাকিতে পারে, প্রশাসনকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হইবে বইকি। পাশাপাশি, অন্য প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে তদন্তেও গতি আসিবে, এমন একটি আশার অঙ্কুর দৃশ্যমান হইতেছে। আসারাম বাপুর বিরুদ্ধে তদন্তের কাজ ঢিমেতেতালায় চলিতেছে কেন, সুপ্রিম কোর্ট গুজরাত সরকারকে তাহার কারণ ব্যাখ্যা করিয়া হলফনামা জমা করিতে বলিয়াছে। আশা করা যায়, ব্যাপম কেলেঙ্কারির তদন্ত বিষয়েও এমন প্রশ্ন উঠিবে। বিচারবিভাগ জানিতে চাহিবে, বসুন্ধরা রাজে বা রমন সিংহের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠিলে সেই তদন্ত অগ্রসর হয় না কেন? গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের স্বার্থেই প্রশ্নগুলি জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy