Advertisement
E-Paper

অন্য জাতীয়তাবাদের গল্প

জাতীয়তাবাদের মুশকিল হল, জাতির একটা ‘শত্রু’ দরকার— একটা অপর, যার বিরুদ্ধতার মাধ্যমেই জাতির একাত্মতা তৈরি হয়। অন্তত, বেশির ভাগ মানুষ তেমনটাই বিশ্বাস করেন। হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ আলাদা, অতএব তারা আলাদা দুটো জাতি, এ দাবির মধ্যে একটা ‘স্বাভাবিকতা’ নিশ্চয়ই ছিল ও আছে।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
উন্নয়নী: পাঞ্চেত জলাধারের উদ্বোধন মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৯

উন্নয়নী: পাঞ্চেত জলাধারের উদ্বোধন মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৯

একটা মোক্ষম প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন যোগেন্দ্র যাদব। এক ইংরেজি ওয়েবসাইটে প্রবন্ধ লিখে প্রশ্ন করেছেন, জাতীয়তাবাদের কথা উঠলে ভারতের উদারপন্থী এলিটরা ভাষা খুঁজে পান না কেন? সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমে এ প্রশ্ন প্রায় অনিবার্য। উদারপন্থীরা জাতীয়তাবাদ নিয়ে কথা বলেন না, সেই শূন্যস্থান পূরণ করে উগ্র (হিন্দুত্ববাদী) জাতীয়তাবাদ। যুদ্ধ ঘোষণার, পাকিস্তানকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার দাবির জাতীয়তাবাদ। যে কোনও প্রশ্নকে সে দেশদ্রোহ বলে দেগে দেয়। শান্তির সময় যদিও বা বুক ঠুকে প্রশ্ন করা চলে, পুলওয়ামার মতো কাণ্ড ঘটলে নিহত জওয়ানদের প্রতি শোকজ্ঞাপনেই ইতি টানতে হয়। তার চেয়ে বেশি কথা বাড়ানো বিপজ্জনক।

জাতীয়তাবাদের মুশকিল হল, জাতির একটা ‘শত্রু’ দরকার— একটা অপর, যার বিরুদ্ধতার মাধ্যমেই জাতির একাত্মতা তৈরি হয়। অন্তত, বেশির ভাগ মানুষ তেমনটাই বিশ্বাস করেন। হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ আলাদা, অতএব তারা আলাদা দুটো জাতি, এ দাবির মধ্যে একটা ‘স্বাভাবিকতা’ নিশ্চয়ই ছিল ও আছে। মহারাষ্ট্রে অ-মরাঠিভাষী অপর, অসমে বাঙালি অপর, দক্ষিণ ভারতে হিন্দিভাষী অপর— যে কোনও খণ্ডজাতীয়তার দাবিতেই সেই ‘স্বাভাবিকতা’র বাস। উদারপন্থার দায় না থাকলে এই স্বাভাবিকতায় গা ভাসানো যায়, মুসলমান এবং/অথবা পাকিস্তান শত্রু, এটাই ভারতীয় জাতীয়তার যথেষ্ট ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। উদারপন্থীদের সে পথে হাঁটার জো নেই। তাই জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন উঠলেই তাঁরা মুখে কুলুপ আঁটেন।

বিদ্বেষ ছাড়া কি তবে জাতীয়তাবাদ অসম্ভব? এই প্রশ্নটাও অনেককে ভাবিয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথ, যেমন সুভাষচন্দ্র। বস্তুত, ঔপনিবেশিক ভারতে জাতীয়তাবাদী চিন্তার একটা ধারা যখন দ্বন্দ্বভিত্তিক পরিচিতি খুঁজেছে, অপর একটি ধারা তখন সন্ধান করেছে সর্বজনীন জাতীয়তার। বিভিন্ন মতে, বিভিন্ন পথে। স্বাধীন ভারতে সে ধারার উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। পরাধীন ভারতে তিনি দলের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে শামিল হয়েও বার বার বলেছেন, নেতি-নির্ভর ধারণা নিয়ে দেশ চলতে পারে না। ঔপনিবেশিক শাসকের প্রতি সম্মিলিত ক্ষোভ বা ঘৃণা পরাধীন দেশে যদি বা এই বিদ্বেষী জাতীয়তাবাদকে খানিক বৈধতা দিতে পারে, স্বাধীন দেশে তা অচল। স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রনীতি রূপায়ণে জাতীয়তাবাদের উদারপন্থী ঐতিহ্যকে কেন্দ্রে রেখে তিনি উন্নয়নের ভিত্তিতে তৈরি করতে চেয়েছিলেন জাতির পরিচিতি। ধর্ম, বর্ণ বা ভাষা নয়, তাঁর জাতীয়তাবাদ দেশকে বাঁধতে চেয়েছিল উন্নয়নের সূত্রে। চিন্তাটা আনকোরা ছিল না, কিন্তু উন্নয়ন যে পরিচিতির পার্শ্বচরিত্র নয়, মধ্যমণি, রাষ্ট্রীয় বয়ানে সেটা এত জোর দিয়ে বলা নেহরুর অবদান।

অস্বীকার করার উপায় নেই, জাতির এ পরিচয়টি আরোপিত। বস্তুত, ভারতের হরেক জাতীয়তাবাদী স্রোতে নেহরুবাদী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই কোনও প্রাকৃতিক, আদিম পরিচিতির গল্প ছিল না। আর, সেই কারণেই এই ধারণাটির গুরুত্ব অপরিসীম। দ্বন্দ্ব থেকে উঠে আসা পরিচিতিগুলো পাশে সরিয়ে রাখতে হলে উন্নয়নের ‘কৃত্রিম’ পরিচিতির একতাই অস্ত্র হতে পারে— এটা ভাবতে পারার মধ্যেই আছে মস্ত রাজনৈতিক কল্পনাশক্তি। অবশ্য, নেহরু অর্থনীতির চশমা দিয়েই দেখতেন। ১৯৩৮ সালে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহের পর যখন বেশ কিছু দিন ঔপনিবেশিক দমনপীড়ন চলল, তার পর হিন্দুদের একাংশ ক্রমে ইংরেজি শিক্ষার দিকে ঝুঁকল, সরকারি চাকরি পেল, মুসলমান সমাজ রয়ে গেল সামন্ততান্ত্রিক গণ্ডিতে। কিন্তু এক প্রজন্মের ব্যবধানে তারাও লেখাপড়া শিখল, চাকরির খোঁজ করল। আর সেখানেই সংঘাত ঘটল হিন্দুদের সঙ্গে। ভারতে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মূল এখানেই। এই ভাবনায় অতিসরলীকরণ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু নেহরু এ ভাবেই ভাবতেন। তাঁর জাতীয়তাবাদের ধারণাও দাঁড়িয়ে আছে অর্থনীতির অস্ত্রে সব সমস্যার মোকাবিলা করার ভাবনার জমিতে। ইতিহাস সাক্ষী, তা হয় না। উন্নয়নের ভাষ্যে ধর্ম-বর্ণ-ভাষার পরিচিতি ঢাকা পড়ে না, তার দ্বন্দ্বও নয়। কিন্তু, ইতিহাস আবার এটাও দেখিয়েছে যে, উন্নয়নভিত্তিক জাতীয়তাবাদের আখ্যানটি কথায় ও কাজে ধরে রাখা গেলে অন্য স্রোতগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকে। নদীবাঁধকে আধুনিক ভারতের মন্দির বলে স্বীকার করতে শিখলে রাম মন্দিরের দাবিকে জাতীয় মঞ্চ থেকে দূরে সরিয়ে রাখায় যায়।

এই সর্বভারতীয় উন্নয়নের কল্পনা ভারতের উদারপন্থী এলিটদের কাছে জাতীয়তাবাদের একমাত্র গ্রহণযোগ্য বিকল্প। এর জন্য বিদ্বেষের জমি প্রয়োজন নেই বলেই। এই উন্নয়নমুখিতার মধ্যেও অবশ্যই হিংস্রতা ছিল, ভারতের উচ্ছিন্ন আদিবাসীরা সাক্ষ্য দেবেন। কিন্তু সেই হিংস্রতায় বিদ্বেষ ছিল না। আপাতত সে প্রসঙ্গ থাক। শুধু এটুকু মনে রাখলেই চলবে যে ভারতের উদারপন্থী এলিটরা চিরকাল এ রকম ‘জাতিহীন রাষ্ট্রের নাগরিক’ ছিলেন না। স্বাধীনতার পরের কয়েক দশক তাঁদের ভারতীয়ত্বের পরিচিতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল এই উন্নয়নভিত্তিক জাতীয়তা। বস্তুত তাঁরা, রাজনৈতিক মতবাদে কংগ্রেসপন্থী হোন বা না-ই হোন, প্রায় নির্বিকল্প ভাবে নেহরুবাদী। আজও। ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞানমনস্কতা সর্বোপরি উদারবাদ— জাতীয় জীবনের প্রতিটি ইতিবাচক বিশেষ্যের সঙ্গেই নেহরু কার্যত অবিচ্ছেদ্য। তবে? কী এমন হল যে উদারপন্থী এলিটরা সেই উন্নয়নভিত্তিক জাতীয়তার পরিচিতি থেকে সরে এলেন? এতটাই যে, জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ উঠলে তাঁরা অস্বস্তিতে পড়ে যান?

উত্তর আছে ১৯৯১-এর জুলাই মাসে, উদার অর্থনীতির আবাহনে। বাজার এসে রাষ্ট্রকে নিয়ে যাওয়ার আগে দেশের প্রতিটা মানুষের উন্নয়নের সঙ্গে স্বীকৃত ছিল রাষ্ট্রের যোগ। রাষ্ট্রের কাছে গরিব আর বড়লোকের, সাধারণ আর এলিটের, প্রত্যাশা এক ছিল না, প্রাপ্তিও ভিন্ন ছিল, কিন্তু উভয় পক্ষই তাকিয়ে থাকত রাষ্ট্রের দিকে। বাজার এসে খেলাটা পাল্টে দিল। শিক্ষিত, শহুরে, আলোকপ্রাপ্ত ভারতীয়রা বুঝে গেলেন, তাঁদের ভাল থাকা নিশ্চিত করতে বাজারই যথেষ্ট। রাষ্ট্রের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক থাকল শুধু গরিবের। এলিট ভারতীয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রের উন্নয়নী সম্পর্ক ক্ষীণ হতে হতে এক সময় উধাও হয়ে গেল। আর, উন্নয়নভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারণার পায়ের নীচ থেকেও মাটি সরে গেল।

নেহরুর আমলে যে হিন্দু জাতীয়তাবাদ গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়, ভারতে তার পুনরুত্থানের সূচনালগ্ন হিসাবে সচরাচর বলা হয় ১৯৮৬ সালের কথা, যখন রাজীব গাঁধী বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেন রামলালার ভক্তদের জন্য। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২-এর কথাও ওঠে। জুলাই ১৯৯১ অনুক্ত থেকে যায়। কিন্তু ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানের পিছনে বাজার অর্থনীতির আবাহনের গুরুত্ব অসীম। এক ধাক্কায় না হলেও, বাজার ক্রমে ভারতীয় এলিটদের সরিয়ে নিল উন্নয়নী জাতীয়তার আখ্যান থেকে। ১৯৪৭ থেকে বহু মেহনতে অর্জিত জমি হিন্দুত্ববাদের হাতে অবলীলায় ছেড়ে দিয়ে উদারপন্থী ভারতীয়রা সরে গেলেন বাজারের কোলে। আর সেই ফাঁকে ছাতি-চাপড়ানো পৌরুষের নাগপুরি দর্শন দখল করে নিল জাতীয়তাবাদের ভাষ্যকে। জাতীয়তাবাদ বললে সর্বজনীন উন্নয়নের কথা আজ মনে পড়ে না কারও।

গৈরিকবাহিনীর খপ্পর থেকে জাতীয়তাবাদের ভাষ্যকে উদ্ধার করতে হলে নেহরুবাদী জাতীয়তার ভাষ্যকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু বাজারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা উদারপন্থী এলিটকে কী ভাবে ফিরিয়ে আনা যায় রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ভাষ্যে? কী ভাবে তাকে বিশ্বাস করানো যায় যে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন শুধু গরিবের জন্য নয়, প্রান্তিকের জন্য নয়, তার প্রয়োজন সবার? তার জন্য বাজার অর্থনীতিকে অস্বীকার করার প্রয়োজন নেই। তেমন দাবি বাস্তবের ধোপে টিকবে না, টিকলেও তার সুফলের আশা ক্ষীণ। কিন্তু, ভাবনার স্তরে উন্নয়নকে পরিচিতির কেন্দ্রে রাখাই যায়। কর্মসংস্থানহীনতার হার অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, এটা শুধু একটা পরিসংখ্যান, বা একটা সমস্যা হিসেবে না দেখে তাকে দেশের সঙ্গে, জাতির সঙ্গে শত্রুতা হিসেবে দেখা যায়। উন্নয়নের অধিকার থেকে দেশের মানুষকে বঞ্চিত করার শত্রুতা। কৃষকের আয়বৃদ্ধি না হওয়া অথবা প্রাথমিক শিক্ষা-স্বাস্থ্যে অবহেলাকে চিহ্নিত করা যায় উন্নয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে।

উন্নয়নের সমতাকে জাতির পরিচিতি হিসেবে দেখার সু-অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে পারলে, অভ্যাসটাকে বহুজনীন করতে পারলে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তার জমি খানিক হলেও কেড়ে নেওয়া যাবে। দেশকে ভালবাসা মানেই যে পড়শি দেশের সর্বনাশের স্বপ্ন দেখা নয়, বরং দেশের আনাচেকানাচে উন্নয়ন পৌঁছে দেওয়া, এই আকালে কথাটা জোর গলায় বলার সাহস পাবেন হয়তো অনেকে।

Nationalism Liberal Pulawama Terror Attack
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy