Advertisement
E-Paper

কলকাতা কেন এমনটা পারে না?

‘ভারতীয় সিনেমা’ মানে যখন দাঁড়িয়েছে বলিউড, তখন হায়দরাবাদ শহরে কয়েক বছর ধরে এক অন্য ভারতের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা চলছে।শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ছেলেটা, আর তুমুল উল্লাসে তেতে উঠছে গোটা হল। শহরটা কলকাতা, হলটা প্রসাদ প্রিভিউ থিয়েটার। হায়দরাবাদের বানজারা হিল্‌স-এর এই প্রেক্ষাগৃহে বসে টানা তিন দিন লাগাতার ছবি দেখছিলেন সে শহরের মানুষ। তার মধ্যেই একটা ছবি ‘বাবার নাম গান্ধীজি’।

শিলাদিত্য সেন

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
বাজারের প্রান্তে। ‘ব্রিজ’ ছবির একটি দৃশ্য। স্থিরচিত্র: শুভময় মিত্র

বাজারের প্রান্তে। ‘ব্রিজ’ ছবির একটি দৃশ্য। স্থিরচিত্র: শুভময় মিত্র

শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ছেলেটা, আর তুমুল উল্লাসে তেতে উঠছে গোটা হল। শহরটা কলকাতা, হলটা প্রসাদ প্রিভিউ থিয়েটার। হায়দরাবাদের বানজারা হিল্‌স-এর এই প্রেক্ষাগৃহে বসে টানা তিন দিন লাগাতার ছবি দেখছিলেন সে শহরের মানুষ। তার মধ্যেই একটা ছবি ‘বাবার নাম গান্ধীজি’। সে ছবির শরীর জুড়ে এমন এক কলকাতা যার খবর আমরা প্রায় রাখিই না, সে ছবির হিরো এমন এক ছোকরা যাকে আমরা চিনতেই চাই না। কেঁচো, ছেলেটার নাম, শুনলেই আমাদের গা গুলিয়ে ওঠে। প্রাণপণে তাকে আমরা আমাদের ছেলেমেয়ের সঙ্গে পড়তে বা মিশতে বাধা দিই। তাতে অবশ্য থোড়াই কেয়ার তার, ভদ্রলোকেদের তোয়াক্কাই করে না ফুটপাথের এই ছেলেটা। সে যেন হাঁক পাড়ে ‘শুনুন যারা মস্ত পরিত্রাতা/ এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা/ হেঁটে দেখতে শিখুন... সাহেব বাবুমশায়!’ (শঙ্খ ঘোষ, ‘বাবুমশাই’)

আমার পাশে বসে ছবিটা দেখছিলেন কেরলের মধু এরাভানকারা, সিনেমা পড়ান সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে, বললেন, এ বাস্তবতা তাঁর রীতিমতো চেনা, কেঁচো-রা এ ভাবেই বাঁচে। মধু হয়তো তাঁর দক্ষিণ ভারতীয় অভিজ্ঞতা থেকে বলছিলেন, আদতে এটি গোটা ভারতেরই চালচিত্র, যে ভারত প্রতিদিন পিছিয়ে পড়ছে উন্নয়নের ডামাডোলে ভূষিত ভারত থেকে, যে ভারতে কুলীন পরিত্রাতাদের পাশাপাশি প্রান্তিক বা ব্রাত্যরা কোণঠাসা হয়ে বাঁচে।

পঁচিশ-পেরনো পাভেল, ছবিটির পরিচালক, কেঁচোদের লেখাপড়া শেখানোর অভিপ্রায় থেকেই এ ছবি করেছেন, জ্যান্ত কেঁচোকে তুলে এনেছেন তার পারিপার্শ্বিক থেকে। গত বছর যখন গাঁধীজির জন্মদিনেই রিলিজ করা হয়েছিল ছবিটা, যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের ভাল লেগেছিল। কিন্তু ক’দিনই বা চলেছিল, কতটুকুই বা প্রচার পেয়েছিল? অথচ কিছুকাল আগে বলিউডের এক বাজার-সফল ছবির কথা খেয়াল করুন, বাবু বাঙালিরা আহ্লাদে একেবারে মাত হয়ে গেলেন— আহা-হা-হা, কী সুন্দর কলকাতা-ই না দেখিয়েছে! বলিউড এখন আমাদের ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে গিয়েছে, রান্নাঘর অবধি। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনেরও নিয়ামক; আমাদের রুচি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ভ্রমণ, প্রেমজীবন— সব কিছুরই নিয়ন্ত্রক। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ এমন এক হুল্লোড়ে ভারতীয়তার জন্ম দিয়ে চলেছে ছবির পর ছবিতে, যা শুধু একপেশেই নয়, একমাত্রিকও।

ঠিক এর সমান্তরালে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-প্রদেশ সাপেক্ষ ফিল্মগুলি ভারতীয়তার নতুন আয়তন এনে দিচ্ছে। আঞ্চলিক ছবিই তার বহুস্বর আর বহুস্তরীয় বুননে নিয়ত চেষ্টা করে চলেছে ভারতীয় জীবনের জটিল বিন্যাসকে রপ্ত করতে, এ দেশের প্রতিটি প্রত্যন্ত প্রদেশ থেকে আলো না পাওয়া বা মুখ বুজে পড়ে থাকা যে জীবন তা তুলে আনতে। জাতির ও দেশের আত্মবিকাশের নানা সংকট নিয়ত বিষয় হয়ে উঠছে আঞ্চলিক ছবিতে। দেশ পরিচয়ের পক্ষে এই বিষয়-সচেতনতা খুব জরুরি শুধু নয়, সমকালীন ইতিহাস তৈরিতেও প্রাসঙ্গিক।

আমি সে সব আঞ্চলিক ছবির কথাই বলছি, ‘পথের পাঁচালী’ তৈরির পর ষাট বছর ধরে যে-সব ফিল্মের ক্যামেরা আমাদের দেশ আর দেশের মানুষের মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ব্যর্থতা বা সাফল্য সত্ত্বেও খুঁজে বেড়াতে শিখছে। বলিউডে কি ব্যতিক্রম নেই, নিশ্চয়ই আছে, অন্তর্ঘাতও আছে, তবে তা ‘সারফেস রিয়েলিটি’তে, অনেকটাই বলিউডি বাণিজ্য বিপণনের শর্ত মেনে।

বাঙালির জীবন আদতে কতটা ভারতীয় তার একটা আন্দাজ পেতেই ‘হায়দরাবাদ বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, এ বার নিয়ে তিন বছর ধরে চালিয়ে আসছেন ‘বেঙ্গলিজ ইন হায়দরাবাদ’ সংগঠনের বাঙালিরা। উৎসবের অধিকর্তা পার্থপ্রতিম মল্লিক মনে করেন ‘বলিউড ছাড়াও যে অন্য ছবি হচ্ছে, তার একটা প্রমাণ পেতে চাইছি এই উৎসবের ভিতর দিয়ে। তা ছাড়া, নামেই বাংলা ছবি, আসলে আঞ্চলিক ছবির উৎসব।’ সংগঠকদের অন্যতম পিয়ালী চক্রবর্তী খেয়াল করিয়ে দেন ‘বাঙালিরা নন শুধু, হায়দরাবাদের সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষই এ উৎসব দেখতে আসেন।’ সংগঠকদের মূল ভরসা ও জন্মলগ্ন থেকে জড়িয়ে যিনি এ উৎসবে, সেই ফেস্টিভ্যাল-কিউরেটর রত্নোত্তমা সেনগুপ্ত জানালেন, ‘সে সব বাংলা ছবিই বাছাই করেছি, যেগুলি ভারতীয় মুখচ্ছবিকে স্পষ্ট করে তুলবে।’

আসলে সেই পঞ্চাশ-ষাট, এমনকী সত্তর দশকেও, যখন বাংলা ছবির সুসময়, তখনও ‘বয় মিট্‌স গার্ল’-এর যে বিরক্তিকর ফর্মুলা জারি ছিল, এখনও তা শুধু জারি নয়, ক্রমবিস্তারী, নানান শারীরিক ছলাকলা কিংবা পরকীয়া-য়। তার ওপর আবার ভূত, গোয়েন্দা, ক্রাইম থ্রিলার, বিদেশি নিসর্গ-এর উপদ্রব। এ সবের বাইরে ব্যতিক্রমী আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তের ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ বা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সিনেমাওয়ালা’ এ-উৎসবে বিশেষ স্বীকৃতি পেল, ব্যক্তিগত সম্পর্কের তলায় রাজনৈতিক ভাষ্যও চারিয়ে দেওয়ায়, কৌশিকের ছবি তো ভারতীয় সিনেমার সংকটকে জড়িয়েও। ব্রেশ্‌ট-এর ‘থ্রি পেনি অপেরা’ অবলম্বনে যুধাজিৎ সরকারের রাজনৈতিক ছবি ‘কলকাতার কিং’ এ দেশের যে-কোনও শহরের মাফিয়া-দুর্নীতি-শাসকদল-প্রশাসনের গাঁটছড়ার উন্মোচন, আদ্যন্ত সিনেমার ভাষায়। দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত আত্মজনের প্রতীক্ষায় থাকা ব্যক্তিমানুষ কী ভাবে ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেতে পারে, তা নিয়ে পার্থ সেনের ‘অনুব্রত ভাল আছো’ বিষণ্ণ করে রাখে দর্শককে।

চালু সামাজিক কাঠামোর অনুগত দর্শক-রুচি তৈরি করে দিতে পারলে বলিউডের ‘বাজার’ বজায় থাকে। এরই বিরুদ্ধ স্বরের উদ্ভাস উৎসবের উদ্বোধনী ছবি অমিতরঞ্জন বিশ্বাসের ‘ব্রিজ’-এ, শতরূপা সান্যালের ‘অন্য অপালা’, আর দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘নাটকের মতো’-য়। এই বিশাল দেশে প্রতিদিন কী ভাবে দাম্পত্য ভাঙে, বিবাহিত মেয়েদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন বেড়েই চলে, মৃতবৎ বেঁচে থাকে তারা স্বাস্থ্যহীনতায়, পাশাপাশি কর্তৃত্বময় পুরুষ বা স্বামীর হয় প্রবল প্রতাপ, নয়তো অদ্ভুত নীরবতা আর ঔদাসীন্য, তারই আখ্যান ছবিগুলি। দৈনন্দিনে মেয়েদের এই যৌন নিপী়ড়ন বা কাঙ্ক্ষিত যৌনতার অবদমন তেমন কোনও তীব্রতায় ধরা পড়ে না বলিউডের ছবিতে, ঠাঁই হয় না এই অন্ধকার পিছিয়ে-পড়া ভারতের মেয়েদের।

পাভেলের মতো দেবেশের ছবি দেখেও আপ্লুত হায়দরাবাদের দর্শক, তাই দু’জনেরই জুটল সেরা-র শিরোপা। ‘আমি যখন ভিন্ন ভাবনার ছবি করছি, ভিন্ন রুচির দর্শকও তৈরি করে নেব আমি। যে ধরনের ছবি করছি, এটা তার প্রস্তুতি প্রক্রিয়ার মধ্যেই পড়ে।’— দেবেশের এই আত্মবিশ্বাসী বিকল্পের ভাবনা কি আমরাও ভাবতে পারি না? হায়দরাবাদ পারে বলিউডের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আঞ্চলিক ছবির উৎসব করতে, কলকাতা পারে না অন্য প্রদেশের ছবির উৎসব করতে?

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy