Advertisement
E-Paper

কয়লা জীবন, কয়লাতেই মৃত্যু

রানিগঞ্জ আসানসোলের কয়লাখনি অঞ্চলটি প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো। খনিসংলগ্ন গ্রামের পথে ঘোরাঘুরি করলে নজরে পড়ে কয়লা পরিবহণের দু’রকম ব্যবস্থা। প্রথমটা বড় বড় আধুনিক ডাম্পার, কয়লা নিয়ে চলেছে রেল ইয়ার্ডের দিকে। দ্বিতীয়টি হল, যেন প্রাগৈতিহাসিক ভাঙাচোরা কিছু নারীপুরুষ ততোধিক ভাঙাচোরা সাইকেলে বিরাট কয়লার চাঁই নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে একটি বিশেষ গন্তব্যে, যাকে বলে ‘কাঁটা’।

অভিজ্ঞান সরকার

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২৩:০০

মেঘালয়ের অবৈধ ‘ইঁদুরগর্ত’ কয়লা খনিতে আটকে পড়া পনেরো জন শ্রমিকের উদ্ধারকার্য নিয়ে হইচই চলল কয়েক দিন। উদ্ধারকার্যের আয়োজন নিয়ে সরকারি টালবাহানা যতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, খনি শ্রমিকদের পরিচয়, অর্থনৈতিক অবস্থা ও বিপন্ন বাধ্যতা ততটা নয়। মাস না যেতেই পশ্চিমবঙ্গে, বাঁকুড়ার বরজোড়ার বাগুলি গ্রামে আর একটি মর্মান্তিক কয়লা খনি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল তিন জন মানুষের, এক জন নিখোঁজ। মৃতদের নাম হাবাল বাগদি, বিশ্বনাথ বাগদি, কালি বাগদি, নিখোঁজের নাম রিঙ্কু বাউরি। স্থানীয় থানার বয়ানে মানুষগুলি ‘অবৈধ কয়লা খননকারী’। ভূপৃষ্ঠের উপরে বেঁচে থাকার উপায় না পেয়ে বিপদসঙ্কুল ভূগর্ভে নেমেছিলেন তাঁরা, মেঘালয়ের খনিশ্রমিকদের মতোই। তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত নিষাদ গোত্রীয়, অঞ্চলের আদি বাসিন্দা এই তিন বাগদি খনি থেকে বেরিয়ে এলেন মৃতদেহে অপরাধদের ছাপ্পা নিয়ে। পূর্ব জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সাড়ে তিনশো ফুট নীচে হারিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে দশ জন মুসলমান, বাকি পাঁচ জন স্থানীয় জনজাতির বাসিন্দা। এখানে বাউড়ি-বাগদি, ওখানে মুসলিম, ‘অবৈধ’ জীবিকার ভারী চাঙড় বহন করার দায় খালি বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের?

রানিগঞ্জ আসানসোলের কয়লাখনি অঞ্চলটি প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো। খনিসংলগ্ন গ্রামের পথে ঘোরাঘুরি করলে নজরে পড়ে কয়লা পরিবহণের দু’রকম ব্যবস্থা। প্রথমটা বড় বড় আধুনিক ডাম্পার, কয়লা নিয়ে চলেছে রেল ইয়ার্ডের দিকে। দ্বিতীয়টি হল, যেন প্রাগৈতিহাসিক ভাঙাচোরা কিছু নারীপুরুষ ততোধিক ভাঙাচোরা সাইকেলে বিরাট কয়লার চাঁই নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে একটি বিশেষ গন্তব্যে, যাকে বলে ‘কাঁটা’। সেখানে কয়লার ওজন ও বেআইনি বিক্রি হয়। চোরাই কয়লার দর দু’টাকা থেকে তিন টাকা কিলোগ্রাম। সারা দিনে দু’শো কিলোগ্রাম কয়লা বেচলে চারশো টাকা আয়। মাঝে পয়সা দিতে হয় ইসিএল-এর গার্ড, পুলিশ, রাজনৈতিক দল, পঞ্চায়েতের তৈরি চেকপোস্টের লোকেদের। এ-ও চুরি, যদিও তা একটা ব্যবস্থার অন্তর্গত, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই ‘গণতান্ত্রিক ভাবে’ চুরির বখরার ভাগ নিচ্ছে। কেবল দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো দোষ ‘অবৈধ কয়লা খননকারী’-র।

মাটির বহু নীচে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ খনি থেকে কয়লা যেমন তোলা হয়, তেমনই হয় ‘ওপেন কাস্ট প্যাচ’ বা খোলামুখ খনি থেকে। একশো-দু’শো ফুট মাটি সরিয়ে কয়লার স্তরের একটা অংশ উন্মুক্ত করা হয়, পেনসিলের কাঠ সরিয়ে লেডের শিষ বার করে আনার মতো। আসানসোল-রানিগঞ্জের অনেক আন্ডারগ্রাউন্ড খনিই এখন পরিত্যক্ত। পরিত্যক্ত বলেই যে তাতে কয়লা নেই এ রকম নয়। কয়লার স্তর আংশিক কেটে বাকি কয়লা স্তম্ভের মতো রেখে দেওয়া হয়। ভূস্তরের ভার তা ধরে রাখে। স্তরটি চলতে চলতে শেষ হলে অন্য স্তরে খনন শুরু হয়। সব স্তর শেষ হলে খনির উপযোগিতাও শেষ হয়।

দুই শতাব্দী ধরে আসানসোল রানিগঞ্জের ভূগর্ভে এ রকম ফাঁপা অসংখ্য খোপ তৈরি হয়েছে। কিছুটা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে, অনেকটাই অবৈজ্ঞানিক ভাবে। মাটি ধসে যাওয়া ও পুরনো খনিতে আগুন লাগা এখানকার নিত্য সমস্যা। খনি অঞ্চলে দেখা যাবে বড় বড় জলাধার। কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় গর্তের মধ্যে ট্রাক ট্রাক বালি ফেলা হচ্ছে সরকার-অধিগৃহীত ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিডেট বা ইসিএল-এর উদ্যোগে। উদ্দেশ্য, খোপগুলি বুজিয়ে ফেলা।

এই অঞ্চলের প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা হারাধন রায় ১৯৯৭ সালে কয়লাখনির কারণে ধস ও আগুন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন। কয়লাখনির পরিবেশগত দিক নিয়ে মামলা ভারতে সেই প্রথম। ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়, ও ২০০৯ সালে অনুমোদিত মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৩,১৯৬ পরিবারকে পুনর্বাসন দেওয়ার কথা। আজ অবধি এক জনও পাননি। হারাধন রায় ২০০৩ সালেই সিপিআইএম ছেড়ে দেন।

এই পুরনো কয়লাখনিগুলি আসানসোল খনি অঞ্চলের নিরন্ন আদিবাসী ও তফসিলি মানুষের জীবন-মরণের সীমানা নির্ধারক। গর্ত খুঁড়ে বা গর্ত খুঁজে মানুষ নেমে পড়েন খনিতে, খনির ম্যাপ ছাড়াই, ফেলে রাখা কয়লার খোঁজে। কোন শাবলের ঘায়ে কতটা বিপদ তার হিসেব থাকে না। আর রয়েছে কুয়োর মতো ব্যবস্থা, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘ডুকি’। নড়বড়ে কপিকলের ডুলিতে দু’-তিনশো ফুট গভীরে নীচে গিয়ে কয়লা তুলে আনা হয়। আসানসোল-রানিগঞ্জের দামোদর অজয়-সংলগ্ন বহু গ্রামে ‘ডুকি’র গোপন ব্যবহার চলছে।

বরজোড়ার দুর্ঘটনাটি বন্ধ-থাকা একটি কয়লাখনিতেই ঘটেছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন খনিটি ‘বেঙ্গল এমটা’-র কাছ থেকে কিনেছিল। কয়লা উৎপাদন বন্ধ ছিল, কোনও রক্ষী নাকি ছিল না। হাবাল বাগদিরা ছ’জন সত্তর ফুট নীচে গিয়েছিলেন, গর্ত ধসে চাপা পড়ে যান। খনি অঞ্চলে কান পাতলে পুরনো খনির ছাদ, দেওয়াল ধসে বহু মৃত্যুর খবর শোনা যায়।

স্থানীয়দের অনুযোগ, খনিতে মৃত ‘অবৈধ’ খননকারীর দেহ উদ্ধার করতে নারাজ কর্তৃপক্ষ। খনির মতোই, খনির প্রশাসন ব্যবস্থাতেও কত ফাঁকফোকর সেটা ধরা পড়তে পারে, এই আশঙ্কায়। আইন অনুসারে, কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ইসিএল-এর স্থায়ী কর্মীদের ক্ষতিপূরণ ও পরিবারের এক জনকে চাকরি দিতে হবে। অস্থায়ী কর্মীদের ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনের চাপে ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। ‘অবৈধ’ খননকারীদের মৃত্যুর খবর ফাঁস হলে দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। খবর চেপে দিলে মৃতকে স্রেফ মুছে দেওয়া যায়।

আন্ডারগ্রাউন্ড খনিতে বিনিয়োগ বেশি, নিরাপত্তার ঝক্কি বেশি, শ্রমিকের প্রয়োজনও বেশি, তাই ইসিএল-এর ঝোঁক খোলামুখ খনির দিকে। পাণ্ডবেশ্বর, জামবাদ, রামনগর, সোনপুর বাজারি ইত্যাদি অঞ্চলে ঘুরলে এক অদ্ভুত ভূপ্রকৃতি নজরে পড়বে। মাইলের পর মাইল জুড়ে জমানো পাথরের ঢিবি আর টিলা। ঢিবিগুলির কেন্দ্রে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে বিরাট হাঁ-করা ক্ষতের মতো খোলামুখ খনি। মাটি চিরে ‘হেভি আর্থ মুভিং’ মেশিন দিয়ে কয়লা তোলা হচ্ছে। এক দিকে মাটি খুঁড়া হচ্ছে, অন্য দিকে সেই মাটি-পাথর ফেলে পাহাড় বানানো হচ্ছে। নারকীয় শব্দ ও দৃশ্যে প্রলয়-উত্তর পৃথিবীর অনুভূতি জাগে।

কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠন হাওয়ার পর এক বছরের মধ্যে শুধু রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলে আশিটি নতুন খোলামুখ খনি শুরু, এবং আরও সাতটি খোলামুখ খনি সম্প্রসারণের ছাড়পত্র পেয়েছে ইসিএল। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইন করে কয়লার ব্লক বেসরকারি ক্ষেত্রের কাছে উন্মুক্ত করা হয়েছে। প্রশ্ন হল, ইসিএল-ই যেখানে খোলামুখ খনির নিয়মকানুন মানে না, কাঁচা টাকার কারবারি খাদান ব্যবসায়ীদের থেকে সেখানে কী আশা করা যায়? নিয়ম হল, খোলামুখ খনির কাজ শেষ হয়ে গেলে মাটি ভর্তি করে জমি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে। আজ পর্যন্ত তার একটিও উদাহরণ নেই।

আন্ডারগ্রাউন্ড খনির ক্ষেত্রে মাটির উপরে মানুষ বসবাস করেন, চাষবাস নগর গ্রাম সবই থাকে। খোলামুখ খনি সব ধ্বংস করে গিলতে থাকে। আশেপাশের চাষের জমি নষ্ট করে, জলস্তর নামিয়ে দেয়। মাটির উপরে ইসিএল-এর জমির বাসিন্দারা নতুন করে গৃহহীন হচ্ছেন, বাউড়ি-বাগদি ছাড়াও দীর্ঘ দিন আগে খনিতে জীবিকার সন্ধানে আসা ছোটনাগপুর, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশার জনজাতির মানুষরা ফের উদ্বাস্তু হচ্ছেন। কিন্তু অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই, কয়লাই জীবন। মেশিননির্ভর উত্তোলন শ্রমিকের কাজ কেড়েছে। অগত্যা ঝুড়ি করে কয়লা চুরি করে পেট চালান তাঁরা। হাতে দুটো পয়সাও থাকে। খনির রাজনৈতিক দল, পুলিশ, মাফিয়া, কর্তৃপক্ষের পুকুরচুরি নিয়ে তৈরি হয়েছিল ছবি, ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর।’ দুর্ধর্ষ চিত্রনাট্যে হিংসা আর দুর্নীতির উদ্‌যাপন মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। বাগদি-বাউড়িরা কিন্তু অলক্ষ্যে থেকে গিয়েছেন।

এক ঠিকা শ্রমিককে প্রশ্ন করেছিলাম, খনির তলায় কী রকম অনুভূতি হয়? ভেবেছিলাম, হয়তো খনির ঘন অন্ধকারময় জীবনের কথা বলবেন। উনি বললেন, গরমকালে এ দিকে চাঁদি ফাটা গরম, কিন্তু খনির তলায় এয়ারকন্ডিশনের মতো ঠান্ডা, তাই ভাল লাগে। এ ভাবেই এখানকার মানুষ বোধ হয় জীবনের প্রাপ্তি খুঁজে নেন। বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে নেন ওই ইঁদুরের গর্তের খনির মধ্যে।

Death Coal Mine Colliery Workers
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy