Advertisement
০৫ মে ২০২৪

সংরক্ষিত আসনে অনীহা কেন বেসরকারি বাসের?

উত্তরবঙ্গের অগণন মানুষ বেসরকারি বাসে যাতায়াত করেন। কিন্তু মহিলা আর অসমর্থদের জন্য নেই নির্দিষ্ট আসন। লিখছেন সোনালি ঘোষ।এক হাতে তিনি ধরে রেখেছেন বাচ্চাটিকে। অন্য হাতে ধরে আছেন বাসের রড। বাসের ঝাঁকুনিতে কেঁপে যাচ্ছে তাঁর কোলের বাচ্চাটি। মাঝে মাঝে কেঁদেও উঠছে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০৫:৪৩
Share: Save:

অফিস টাইমে ভিড়ে ঠাসা বেসরকারি বাসের খুব পরিচিত একটা দৃশ্য। কোলে বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রমহিলা। এক হাতে তিনি ধরে রেখেছেন বাচ্চাটিকে। অন্য হাতে ধরে আছেন বাসের রড। বাসের ঝাঁকুনিতে কেঁপে যাচ্ছে তাঁর কোলের বাচ্চাটি। মাঝে মাঝে কেঁদেও উঠছে।

কপাল ভাল হলে সামনের আসনে বসা কোনও যাত্রী হয়তো বলবেন— ‘বাচ্চাটাকে আমার কাছে দিন।’ কপাল আরও বেশি ভাল হলে নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কেউ হয়তো বলবেন— ‘আপনি বসুন।’

অথবা, ধরা যাক বর্ষার কোনও একটা দিন। সপসপে ভেজা রেনকোট পরে দু’হাত দিয়ে রড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন এক মহিলা। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে একটা-দু’টো মন্তব্য— ‘আপনার রেনকোটের জলে আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে! একটু সরে দাঁড়ান না!’ কিংবা ভেজা ছাতা হাতে ধরেই রড আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছেন কোনও মহিলা। তাঁর ছাতা থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ে আরও ভিজিয়ে দিচ্ছে তাঁকে। সহযাত্রীদের কেউ কেউ বলছেন সরে দাঁড়াতে। কিন্তু তিনি সরবেন কোথায়? যেখানে পা ফেলারই জায়গা নেই, সেখানে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা হাস্যকরই! এর মধ্যেই বাস কনডাক্টরের আবেদন— ‘সাইড দিন, দিদি!’

আমাদের মতো নিত্যযাত্রীদের কাছে এ সব প্রতিদিনের খুব চেনা দৃশ্য। কিন্তু কিছু করার থাকে না। আমি নিজেই-বা কতদিন বাসে উঠে বসার জায়গা পাই? এর সঙ্গেই রয়েছে আরও এক ছবি। সে ছবি আরও করুণ! প্রতিবন্ধী যাত্রীদের কী হবে? তাঁদের আসন ছেড়ে দেওয়ার মতো মহানুভব সহযাত্রীর সংখ্যা কত? আসন ছাড়ার আগে মানুষটি আদৌ প্রতিবন্ধী কি না বা কত শতাংশ প্রতিবন্ধী, সে সব বিবেচনা করতেই তো ব্যস্ত থাকেন লোকজন! কী হবে বৃদ্ধ যাত্রীদের?

এই সব ছবি উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ রুটের বেসরকারি বাসের। এখানকার সরকারি বাসে মহিলাদের জন্য, প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও বেসরকারি বাসে সেটা নেই বললেই চলে। ফলে, প্রতিদিনই অসংখ্য মহিলা বাসে উঠে চরম অস্বস্তি ভোগ করেন। চবড়ান্ত সমস্যায় পড়েন শারীরিক ভাবে দুর্বল মানুষজন এবং প্রতিবন্ধীরা।

নারী-পুরুষ দু’পক্ষেরই সমানাধিকার, এটা মেনে নিলেও কি বাসে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকা উচিত নয়? যুগলালিত এই তর্কের মধ্যে ঢুকে হয়তো লাভ নেই! কারণ, পুরুষদের মধ্যে একাংশ বিশ্বাস করেন যে, এই বিশেষ ‘সুবিধা’র কোনও প্রয়োজন নেই! যদিও এই মনে করার পিছনে কোনও যুক্তি নেই!

প্রতিদিনের বাসযাত্রার সুবাদে বেশ কিছু মন্তব্য মুখস্ত হয়ে গিয়েছে! যেমন, ‘আমি তো সাইড নিয়েই দাঁড়িয়ে আছি! আপনার অসুবিধা হলে আপনি সরে দাঁড়ান!’ অথবা, ‘এত অসুবিধা হলে নিজের গাড়িতেই যাওয়া দউচিত!’ কিংবা, ‘চাকরি করব, কিন্তু কষ্ট করব না! চাকরি ছেড়ে দিলেই তো হয়!’

এ সব কথার উত্তর দেওয়া হয়ে ওঠা না! কারণ, লাভ নেই! কিন্তু বলতে ইচ্ছে করে, শখে নয়, বড় প্রয়োজনে পড়েই চাকরি করতে হয় মেয়েদের। নিত্যযাত্রী অনেক মহিলাকেই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে বাস ধরার সময়টুকুর মধ্যে অনেকগুলো কাজ করতে হয়। সাতসকালে ছেলেমেয়েকে স্কুলের টিফিন তৈরি করে দেওয়া থেকে শুরু করে বইখাতা আর স্কুলব্যাগ গোছানো। তারপর চা-জলখাবার তৈরি করা পরিবারের জন্য। বাড়িতে পরিচারক বা পরিচারিকা থাকলে তিনি এর মধ্যেই এসে গিয়েছেন। ঘড়ি ধরে কাজ করেন তিনি। সকাল সাড়ে ৭টায় এক বাড়িতে তো ৯টায় অন্য বাড়ি। তাঁরও তাড়া থাকে। তাই হাতে হাতে তাঁর সঙ্গে আনাজপত্র কেটে রান্না বসানো। রান্না শেষ হলে কোনও মতে স্নান সেরে ভাত বেড়ে দেওয়া। নিজের ভাতটাও বেড়ে নেওয়া। নাকেমুখে গুঁজে খাওয়া শেষ করে এঁটো বাসনপত্র রান্নাঘরের সিঙ্কে নামিয়ে তড়িঘড়ি তৈরি হওয়া। এর মধ্যে নিজের ব্যাগটাও গুছিয়ে নেওয়া, যেটার মধ্যে নিজের টিফিন থেকে শুরু করে টুকিটাকি এটাওটা রাখা থাকে। তারপর বাসের জন্যে প্রায় দৌড়। বাসে নিত্যদিনের যুদ্ধ। সে যুদ্ধ করতে করতেই কর্মস্থলে পৌঁছান। সেখান থেকে ফেরার সময় আবারও বাসযুদ্ধ। শরীর তখন আর নিতে পারে না। কিন্তু, এখানেই শেষ নয়। সন্ধ্যাবেলা ছেলেমেয়েকে নিয়ে পড়তে বসানো। তারপর রান্না। কোনও কোনও দিন বাসনমাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়াও। অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী, রান্না করা, ঘর ঝাঁট দেওয়া বা বাসন মাজা— এই সব কাজগুলো মহিলাদেরই সামলাতে হয়।

নিত্যযাত্রী বহু মহিলার প্রতিদিনের রুটিন কম-বেশি এই রকমই। এর সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে প্রতি মাসের শারীরিক পর্বের দিনগুলোকেও। যে অস্বস্তিটা কোনও পুরুষ যাত্রীকে কখনওই বহন করতে হয় না।

তা হলে, বাসে মহিলাদের জন্যে কেন নূন্যতম স্বাচ্ছ্যন্দটুকুরও ব্যবস্থা থাকবে না? কেনই-বা অন্যের অস্বস্তিকর স্পর্শ এড়ানোর জন্য তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে? কেনই-বা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একজন মহিলা বাসে এতটা কষ্টভোগ করবেন?

মহিলাদের জন্যে বাসে সংরক্ষিত আসন থাকলেও যে সব মহিলা যাত্রী সেখানে বসার সুযোগ পাবেন, তা নয়। কিন্তু, কিছু সংখ্যক মহিলা তো পাবেন। সেটাই-বা কম কীসের?

সাতসকাল থেকে দৌড় শুরু করার পর কিছুক্ষণের জন্যে সামান্য বসার আরামটুকু তো অন্তত পাওয়া যাবে। একই কথা আরও গভীর ভাবে সত্য প্রতিবন্ধীদের জন্যও। সরকারি বাসে যে ব্যবস্থা রয়েছে, কেন বেসরকারি বাসে তা থাকবে না?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Reserved Sea Private Bus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE