Advertisement
E-Paper

কেন বাংলা ইস্কুলের চাহিদা নেই 

কারণ, ভয়। এক দিকে যখন এক দল চিন্তাবিদ বাংলা ভাষায় শিক্ষা-সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চাইছিলেন তখন আর এক দল শুধু ইংরেজির পক্ষপাতী। ইংরেজি জানলেই চাকরি হবে এই ভাবনার অনুসারী তাঁরা। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বিদ্যালয় স্তরে বাংলা মাধ্যম ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ ভাবে চালু হল।

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৮ ০০:০০

কলকাতা শহরের পঁচাত্তরখানা বাংলা-মাধ্যম ইস্কুল অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন গুনছে। পড়ুয়া নেই। কী হবে? চাহিদাহীন বিষয়-আশয়কে বন্ধ করে দেওয়ার দস্তুর অনেক দিনের। তবে চাহিদা কেন নেই তা একটু তলিয়ে ভাবা দরকার, চাহিদা কেমন করে তৈরি করা যায় সে পরিকল্পনাও জরুরি। বাংলা মাধ্যম ইস্কুল বলতে যতই আবেগে গলা কেঁপে উঠুক, এই ব্যবস্থা চিরকালীন নয়, বিশেষ দেশ-কালে গড়ে উঠেছিল। উনিশ শতকে সাহেবি উদ্যোগের সুবাদে যে ভার্নাকুলার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তারই ক্রম-সম্প্রসারিত ফল এ-কালের বাংলা মাধ্যম ব্যবস্থা। সাহেবরা এ-দেশে শিক্ষা সংস্কার করতে গিয়ে বুঝেছিলেন বই-খাতা, স্লেট-খড়ি নিয়ন্ত্রিত পাশ্চাত্যে প্রচলিত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অন্যান্য উপকরণ নির্ধারিত শিক্ষা দেশজ ভাষায় দিলে শিক্ষার প্রসার দ্রুত হবে। এই পরিকল্পনা থেকেই ভার্নাকুলার স্কুলের উদ্ভব। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় এ-জাতীয় স্কুল গড়ে তোলা হল। আগেকার দেশজ বিদ্যালয়গুলি পিছু হটল।

সাহেবদের এই উদ্যোগ জাতীয়তাবাদীরা ক্রমে নিজেদের মতো করে গ্রহণ করলেন। শিক্ষার বাংলা ভাষাবাহিত সংস্কৃতিতে বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র, রাজশেখর বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এমন অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। এঁরা সকলেই খুব ভাল ইংরেজি জানতেন, নানা পেশায় তাঁরা নিযুক্ত। বাংলা ভাষাবাহিত শিক্ষা-সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য বাংলা প্রাইমার, পরিভাষা, অভিধান, উচ্চ শিক্ষার পাঠ্যবই রচনায় এঁরা অংশগ্রহণ করলেন। তাঁরা বুঝতেন এ-দেশের মানুষ রাস্তায়, বাড়িতে পথেঘাটে যে ভাষায় কথা বলেন সেই ভাষার মান্য একটি রূপকে বিদ্যালয়ে ও উচ্চতর শিক্ষায় ব্যবহার করলে পড়াশোনার বিকাশ সহজ হয়। তবে সেটা তো এমনি-এমনি হবে না, তার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করতে হবে— ভাষাটা গড়ে-পিটে নেওয়া চাই। দুশো বছরের চেষ্টায় পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা বাংলায় শিক্ষার সংস্কৃতি নির্মাণ সম্ভব হয়েছে।

প্রশ্ন হল, তা হলে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের প্রতি আজ এই ক্রমবর্ধমান অনীহার কারণ কী? কারণ, ভয়। এক দিকে যখন এক দল চিন্তাবিদ বাংলা ভাষায় শিক্ষা-সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চাইছিলেন তখন আর এক দল শুধু ইংরেজির পক্ষপাতী। ইংরেজি জানলেই চাকরি হবে এই ভাবনার অনুসারী তাঁরা। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বিদ্যালয় স্তরে বাংলা মাধ্যম ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ ভাবে চালু হল। মাধ্যমিক পর্যন্ত বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের যে আধুনিক চেহারা, তার প্রাথমিক ভিত্তি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সময়ই নির্মাণ করেছিলেন। তখন মাধ্যমিক-এর নাম ছিল ম্যাট্রিকুলেশান। সে সময়ে বহু প্রধান শিক্ষক শ্যামাপ্রসাদের বিরোধিতা করেন। তবে বাংলা ভাষার শিক্ষা-সংস্কৃতি যে ফেলনা নয় তা ক্রমেই বোঝা গিয়েছিল। যাঁরা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করবেন তাঁরা ইংরেজি শিখবেন এও স্বীকৃত হয়েছিল। বাংলা-মাধ্যম বলতে ইংরেজিবিহীন সংকীর্ণ শিক্ষাকে বোঝানো হয়নি।

স্বাধীনতার পর কলকাতায় ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বেশ কিছু ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল যেগুলি দেশজ সংস্কৃতিকে অস্বীকার করেনি। কলকাতার ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে কমলকুমার মজুমদার আঁকা শেখাতেন, উৎপল দত্ত ইংরেজি পড়াতেন। রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত অনেক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম একসঙ্গে পাশাপাশি চলত। এই বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা ছাত্ররা বাংলা ভাষাসংস্কৃতির সঙ্গে সুপরিচিত। সেখানকার ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রও চমৎকার বাংলা জানেন, বাংলা মাধ্যমের ছাত্র যথেষ্টই দক্ষ ইংরেজিতে। বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়ে বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত— আজ যে এমন প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সংখ্যায় প্রচুর, তার কারণ এই যে ইস্কুলে তাঁরা দুটো ভাষা ভাল করে শিখতে পেরেছিলেন।

সমস্যাটা তা হলে দুই রকম বিদ্যালয়কে নিয়ে। এক, সেই বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয় যেখানে ইংরেজি শেখানোর পরিকাঠামো নেই। শিক্ষকদের উদ্যোগ কম। আশির দশকের শেষ থেকে এই সমস্যার দ্রুত বৃদ্ধি। বাম শাসনকালে কী ভাবে ইংরেজি পাঠ্যসূচির বদল করে ও বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজিকে বিদায় জানিয়ে পড়াশোনায় সহজিয়াতন্ত্র চালু হয়েছিল, সবারই জানা। সেই সময়ই মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি ওই বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয় থেকে তাঁদের ছেলে-মেয়েদের তুলে নেন। বিদ্যালয় শিক্ষকেরা ক্রমশ পার্টিতন্ত্রের অংশ হয়ে উঠে আসল কাজ থেকে বিচ্যুত হন। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের চলে যেতে দেখে অন্য শ্রেণির মানুষেরাও বাংলা-মাধ্যমে ভরসা হারান। সেই সুযোগে পাড়ায় পাড়ায় ‘ভেকচ্ছত্রবৎ’ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের আবির্ভাব। এই সব ইস্কুলের অধিকাংশেরই শিক্ষাদর্শ নেই, যোগ্য শিক্ষক নেই, ইংরেজি শেখানোর মুরোদ নেই, শুধু ‘ইংরেজি-মাধ্যম’ তকমাটুকু আছে। এই ইস্কুলেই বাবা-মায়েরা ভয়ে ভয়ে তাঁদের ছেলে-মেয়েদের পাঠিয়ে দেন। পরিকাঠামোহীন টিমটিমে বাংলা-মাধ্যম ইস্কুলের থেকে এই গজিয়ে-ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম তাঁদের কাছে শ্রেয় ঠেকে।

আসল কথা, বাংলা ইংরেজি দুটো ভাষারই সংস্কৃতি আছে। সে সংস্কৃতি জানা চাই। এ দেশের ইংলিশ-মিডিয়াম ইংল্যান্ড-আমেরিকার ইস্কুলের মতো কেন হবে? দেশজ ইংলিশ-মিডিয়াম ইস্কুল দেশজ-সংস্কৃতির দিকে মন দেবে, এটাই তো কাম্য। তবে, মনে রাখা ভাল, নিজের ভাষা-সংস্কৃতি যে জানা উচিত এ বোধ এখনও বহু নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেন। পাশাপাশি ভাল বাংলা মাধ্যম স্কুল এখনও বেশ কিছু আছে। সেখানে ছাত্র-সংকট নেই। বরং অসরকারি সেই সমস্ত স্কুলে পড়ুয়ারা সুযোগ পাওয়ার জন্য উন্মুখ।

বাংলা ভাষাটা ফেলনা নয়। আবার বাংলার অহমিকায় ইংরেজি শিখব না, এ কথা বলাও মূর্খামি। শিক্ষা মানে তো কেবল একটা চাকরি জোটানোর জন্য তৈরি হওয়া নয়। ভাল করে ভাবনা-চিন্তা করতে শিখলে, একটা কেন অনেক চাকরির দ্বারই খুলে যেতে পারে। এ দেশের ভাষা-সংস্কৃতিকে স্বীকার করে নেওয়া ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুল যেহেতু সংখ্যায় বেশি নয়, তাই বাংলা মাধ্যমের সার্বিক মানোন্নয়ন করা উচিত। কাজটা শক্ত। তবে চেষ্টা করতে হবে। পঁচাত্তরটা ইস্কুল বন্ধ করা সোজা, বাংলা-মাধ্যমে পড়েও ইংরেজি শিখে সুশিক্ষিত হওয়া যায় এই বিশ্বাস গড়ে তোলা কঠিন। সেই কঠিন কাজ না-করতে পারলে অশিক্ষাই সর্বব্যাপী হবে।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

Education Bengali Medium School Vernacular School Language School
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy