Advertisement
E-Paper

চিলতে হাসিতে বিদ্রুপ, ভালবাসা

ঘুণাক্ষরেও মনে হয় না, গ্রেফতার বা কারাবাস নিয়ে কবির বিন্দুমাত্র তাপ-উত্তাপ আছে। বরং মনে হয়, তাঁর ঊর্ধ্বমুখী মুষ্টিবদ্ধ হাতে লেগে আছে আত্মবিশ্বাস, ঠোঁটের চিলতে হাসিতে বিদ্রুপ ও ভালবাসা।

গৌতম ঘোষদস্তিদার

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০

মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওয়ে দলিতদের উপর উচ্চবর্ণীয় জাতির হামলার সূত্রে একটি অস্বাক্ষরিত চিঠির ভিত্তিতেই পুণে পুলিশ হায়দরাবাদে উজিয়ে এসে গ্রেফতার করেছে প্রবীণ প্রতিবাদী কবি ভারাভারাকে (ছবিতে)। জেলযাত্রা তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। অর্ধেক জীবনই তিনি কাটিয়েছেন জেলে। আগে কংগ্রেস ও তেলুগু দেশম সরকারের জেল দেখেছেন, এ বার হয়তো দেখবেন বিজেপির কারাগার। তবে কিনা ঘুণাক্ষরেও মনে হয় না, গ্রেফতার বা কারাবাস নিয়ে কবির বিন্দুমাত্র তাপ-উত্তাপ আছে। বরং মনে হয়, তাঁর ঊর্ধ্বমুখী মুষ্টিবদ্ধ হাতে লেগে আছে আত্মবিশ্বাস, ঠোঁটের চিলতে হাসিতে বিদ্রুপ ও ভালবাসা। কত জরুরি কাজ রয়েছে তাঁর: কবিতা লেখা, জনমানুষের কবিতা।

ভীমা কোরেগাঁওয়ে দলিতদের গৌরবানুষ্ঠান কেন সঙ্ঘ-প্রাণিত শাসক দলের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে, তা ইতিমধ্যে বহু-আলোচিত। ভীমা কোরেগাঁওয়ের দলিতদের উপর হামলাকারীদের কেশও ছোঁয়নি পুলিশ, গ্রেফতার হয়েছে হামলার শিকার দলিতরাই। তার পর সেই সূত্রেই গ্রেফতার হলেন দেশের বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মীরা।

মুশকিল হল, শাসক দল যে ভাবে দেশাত্মবোধ চেনাবে, সকলেই তো তা মেনে নেবে না। সকলেই যৎসামান্য ইতিহাস পড়েছে। কিন্তু, এই শাসক দলটি কোনও কালেই বহুত্ববাদে আস্থাশীল নয়। তাদের নিজস্ব শাস্ত্র আছে, দেশবোধ আছে। তার সঙ্গে যাদের বনিবনা হবে না, ভিন্ন স্বরে বাজবে, তাদেরই মাওবাদী আখ্যাত করে পাঠাবে কারান্তরালে।

ভীমা কোরেগাঁও হামলার প্রেক্ষিতে আমাদের মনে পড়ে: প্রায় চার দশক আগে অন্ধ্রপ্রদেশের এক ভয়াবহ হামলা। ১৯৮১। সেখানে তখন ক্ষমতায় কংগ্রেস। আদিলাবাদ জেলার ইন্দ্রভেলিতে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় শতাধিক আদিবাসীর। সেই গণহত্যার বিরুদ্ধেও কবিতায় সরব হন ভারাভারা রাও। ‘নামকরণের দিন’ নামে দীর্ঘ কবিতাটি লেখা হয়। কী তীব্র সেই কবিতার ব্যঞ্জনা। গণহত্যার সরকারি তালিকায় অজস্র নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যক্তিনামগুলি পরিণত হয় নিছক সংখ্যায়।

ভারাভারার জন্ম ১৯৪০ সালে, ওয়রঙ্গল জেলার পেন্ডিয়ালায়। তিনি একই সঙ্গে কবি, অধ্যাপক, জনবক্তা, সাহিত্য-সমালোচক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী। তবে তাঁর কবিখ্যাতিই সর্বাধিক। তেলুগু-উপন্যাসভিত্তিক তাঁর গবেষণাগ্রন্থ তেলঙ্গানার স্বাধীনতাযুদ্ধ ও তেলুগু উপন্যাস মার্ক্সীয় সমালোচনা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন ‘সৃজন’ নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা।

বাল্যকালে নিজের রাজ্যে ঘটে গেছে তেলঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ। যৌবনে পরিচিত হয়েছেন চেরাবান্দা রাজু ও গদরের মতো তরুণ তেলুগু চারণকবিদের সঙ্গে। জড়িয়ে পড়েছেন কৃষক আন্দোলনে। জেলে গিয়েছেন। শুরু থেকেই শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামে বিশ্বাস করেছেন ভারাভারা। সত্তরের দশক থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বহু সময় তিনি জেলেই কাটিয়েছেন, কারাবাসের দিনগুলি নিয়ে দিনলিপির আকারে লিখেছেন সহচারুলু (সহগামী)। ১৯৯০ সালে গ্রন্থাকারে বেরিয়েছে সেই বিতর্কিত ও বিস্তারিত রচনা। ১৯৬৯ সালে সমমনা কবিবন্ধুদের নিয়ে সংগঠিত করেন তিরুগুবাটু কবিলু (বিদ্রোহী কবিদল) আন্দোলন। তেলুগু শিল্পসংস্কৃতিতে এই আন্দোলন গভীর প্রভাববিস্তারী হয়। ভারাভারার পত্রিকা ‘সৃজন’ যে ভাবে জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছয়, অতি-বামমুখী পত্রিকার সেই গ্রহণযোগ্যতায় ধাক্কা লাগে প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য ধারায়ও।

জীবনের মহামূল্যবান সময় যাঁর অপচয় হয়েছে জেলে, তিনি কী করে তাঁর অন্তরে জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছিলেন কবিতার অনন্ত বিস্ফার, তা এক রহস্য। আসলে, কবিতা কখনও ভারাভারার কাছে জনজীবনবিরহিত বা রাজনীতিবিচ্ছিন্ন নয়। তাঁর রাজনৈতিক ভাবধারাই অনূদিত হয়েছে কবিতায়, জল বাতাস আলো ও অরণ্যের মতোই তা সহজ ও স্বাভাবিক। বিস্ময় আরও যে, সারা জীবন রাজনৈতিক কবিতা লিখলেও কবিতার নন্দনতত্ত্ব কখনও অগ্রাহ্য করেননি তিনি। এমনকি, বিদ্রোহী কবির কলমে লিরিকের বর্ণচ্ছটাও কম নয়। রাজনীতির ভাষা আর কবিতার ভাষা তাঁর কাছে পারস্পরিক দুই স্তরে বিস্তৃত। ভাষা ও জীবন তাঁর কাছে যেন পরস্পরযুক্ত দু’টি আধার।

রাষ্ট্রের পুলিশই যে চূড়ান্ত নয়, তা বুঝিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। ভারাভারাদের কারাবাস খারিজ করে আপাতত গৃহবন্দি রাখতে বলেছেন প্রধান বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ। আমরাও আপাতত শান্তিকল্যাণে ফিরে মনে আওড়াতে পারি ভারাভারার ‘নামকরণের দিন’ কবিতার একটি অংশ: ‘‘হঠাৎ এল বুনোফুলের গন্ধবিধুর হাওয়া/ বইল আমার মনের ভিতর, এইটুকু তো পাওয়া/ এখন বাতাস যেন লাগছে পাহাড়চূড়ায়/ আকাশ যেন ধনুক হয়ে লাগছে বনের গায়/ পারলে তুমি বণিক ডেকে গোধূলিও দাও বেচে/ গোদাবরীও শুকিয়ে যাবে, থাকবে না কেউ বেঁচে।’’

Varavara Rao State Poem Poet
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy