Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
JP Nadda

নিষ্ঠুর রঙ্গ

নেতা কি এক মুঠি চাল পাইবার অধিকারী? ক্রয়-বিক্রয় কেবল বস্তুর বিনিময়, কিন্তু দানের সম্পর্ক মানবধর্মের সহিত।

ছবি পিটিআই।

ছবি পিটিআই।

শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২১ ০০:০১
Share: Save:

হেলিকপ্টার হইতে নামিয়া জগৎপ্রকাশ নড্ডা বর্ধমানের কৃষকদের নিকট এক মুষ্টি চাল প্রার্থনা করিলেন। গণতন্ত্রের কী বিচিত্র লীলা! বিজেপি ভারতের সর্বাধিক ধনী রাজনৈতিক দল, তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী পাঁচটি প্রধান জাতীয় দলের মিলিত আয় বিজেপির অর্ধেকও নহে। সেই দলের সর্বভারতীয় সভাপতি দরিদ্রের দ্বারে এক মুঠা চালের প্রত্যাশী। কেন এই কৌশল? বাংলার চাষি এক মুঠা চাল দান করিলে কি কৃষকসমাজে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ হইবে? কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ঊনষাট জন চাষি মৃত্যুবরণ করিয়াছেন, কয়েক লক্ষ চাষি এখনও উন্মুক্ত স্থানে পৌষের রাত জাগিতেছেন। বিজেপির শাসনকালে কৃষকদের আয়ের অনিশ্চয়তা বাড়িয়াছে, ২০১৯ সালে ভারতে আত্মঘাতী হইয়াছেন দশ হাজারেরও অধিক চাষি। সম্মুখে নেতাকে দেখিয়া চাষিরা সে সকল কথা বিস্মৃত হইবেন, তাহার সম্ভাবনা কম। বরং গণতন্ত্রের শক্তি দেখিয়া তাঁহারা ফের চমৎকৃত হইতে পারেন। নেতার শক্তি ও সম্পদের উৎস দেশের দুর্বল, নির্ধন মানুষগুলি— পাঁচ বৎসর অন্তর সেই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্র। সে অর্থে দরিদ্রের নিকট নেতার প্রার্থনা নির্বাচনী রঙ্গমঞ্চে আরও একটি কুনাট্য নহে, সার সত্য।

তবে প্রশ্ন উঠিতে পারে, নেতা কি এক মুঠি চাল পাইবার অধিকারী? ক্রয়-বিক্রয় কেবল বস্তুর বিনিময়, কিন্তু দানের সম্পর্ক মানবধর্মের সহিত। ভারতে চতুরাশ্রমের ধারণায় দান গৃহস্থের অন্যতম কর্তব্য। গুরুগৃহে পাঠরত ছাত্র, সন্ন্যাসী, অকিঞ্চন-আতুর গৃহস্থের অন্ন প্রার্থনা করিতে পারে। দাতার মঙ্গলকামনা ভিন্ন অপর কিছু করিবার সাধ্য তাহাদের নাই। আর্থিক লেনদেনের বাহিরেও মানবিক সম্পর্কের একটি পরিসর রহিয়াছে। সেইটির প্রতিও যে সমাজবদ্ধ মানুষের দায় রহিয়াছে, শর্তহীন অন্নদান তাহা মনে করাইয়া দেয়। মুষ্টিভিক্ষা খাদ্যসঙ্কটকে ঠেকাইবার একটি উপায়ও বটে। তাহারই ভরসায় শ্রাবস্তীপুরের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে বাঁচাইবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন এক বৌদ্ধ ভিক্ষুণী। আজ বিজেপির দলীয় কর্মীরা কৃষকদের ঘর হইতে এক মুঠা চাল সংগ্রহ করিয়া গণভোজনের উদ্যোগ করিতেছেন। কর্মসূচি রাজনৈতিক, উদ্দেশ্য দলীয় স্বার্থসিদ্ধি। গ্রামবাসী কি তাহা বোঝেন না? তবু দরিদ্র গৃহস্থও যে অন্নপ্রার্থীকে বিমুখ করিতে পারেন না, তাহার মূলে রহিয়াছে স্বার্থহীন জনসেবার ইতিহাস। নড্ডা কাটোয়ার যে চাষির গৃহে ভোজন করিলেন, তাহার গৃহিণী সাংবাদিকদের বলিয়াছেন, তিনি নড্ডার নিকট কিছুই চাহেন নাই। অতিথি নারায়ণ, তাই অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করিয়াছেন।

ভোট পাইবার তাগিদে বাহুবলী নেতারা ভিখারি সাজিলে দানের পরিচিত পরিপ্রেক্ষিতগুলি এলোমেলো হইয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ যখন গান বাঁধিয়াছিলেন, “এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে”, তখন ভোটরঙ্গের কথা ভাবেন নাই। যাঁহার অভাব নাই, তিনি গৃহস্থের দায়বোধের সুযোগটি লইবেন কেন? নেতা দাবি করিতে পারেন, তাঁহার দলের নীতি কৃষকদের বহু গুণ ফিরাইয়া দিবে। কিন্তু দান তো ঋণ নহে। দানের মূলে রহিয়াছে নিজের সম্পদ অপরের সহিত ভাগ করিয়া ভোগের ইচ্ছা। সকল ধর্মে যাহা প্রশংসিত। সঙ্গতি থাকিলেও যে অন্নদানে বিমুখ, জিশু খ্রিস্ট তাহাকে স্বর্গের অধিকার দেন নাই। ঋগ্বেদ বলিয়াছে, যে একাকী অন্ন ভোজন করে, তাহার পাপ তাহার একারই হয়। নিঃসঙ্কোচে প্রার্থনা নেতার বিনম্রতার পরিচয় হইতে পারে। কিন্তু কৃষকের দান হইতে শিক্ষা লইয়া অন্ন, তথা ন্যূনতম প্রয়োজনগুলি শাসক দল বণ্টন করিবে কি? অতিমারির দুর্দিনেও দরিদ্রকে নিঃশর্তে অর্থ দিতে রাজি হয় নাই কেন্দ্র। দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টি বাড়িয়াছে। অপরের অধিকারকে সম্মান করা সহজ নহে। দরিদ্রকে তাহার প্রাপ্য না দিয়াই তাহার দান গ্রহণ, এ রঙ্গ বড়ই করুণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

JP Nadda BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE