প্রতীকী ছবি।
ঘোমটার গৌরবেই হরিয়ানার পরিচিতি। হরিয়ানার বিজেপি সরকারের একটি পত্রিকায় প্রকাশ পাইয়াছে এই উদাত্ত ঘোষণা। শুনিলে মনে হইতে পারে, অবাক কাণ্ড! কল্পনা চাওলা হইতে গীতা ফোগট, সাক্ষী মালিক হইতে সাইনা নেহওয়াল— হরিয়ানার গৌরব তো রাজ্যের এই কন্যারাই! ঘোমটার কী বা প্রয়োজন? একটু ভাবিলেই রহস্যের সমাধান হয়। আসলে, ভারতীয় সমাজে নারীদের দুই রকম ভূমিকা পালন করিতে হয়। কারণ, ভারতীয় সমাজ দুই প্রকার। প্রগতিশীল এবং প্রত্যাবর্তী। এবং এই দুই সমাজকে যথাযথ রূপে উপস্থাপন করিবার দায়িত্ব কেবলমাত্র ভারতীয় নারীর। এই দেশের সমাজকে প্রগতিশীল হিসাবে বহির্বিশ্বের সম্মুখে পেশ করিতে তাহাকে মহাকাশে যাইতে হয়, অলিম্পিকে পদক জিতিতে হয়, সাহিত্যের জগৎসভা হইতে শিরোপা আনিতে হয়। তখন সে হয় ‘ভারতের কন্যা’। ভারতের ছাতি হইয়া যায় ৫৬ ইঞ্চি। কিন্তু ভারতের আদি ঐতিহ্য তো আর বর্হিবিশ্বে নারীর জয়জয়কারে নহে। ভারতের অন্তরঙ্গকে প্রকৃষ্ট ভারতীয় ঐতিহ্যে প্রস্ফুটিত করিয়া তুলিতে, ভারতীয় কন্যাদেরই মাথায় ঘোমটা টানিয়া গোয়াল নিকাইতে হয়, কূপ হইতে জল তুলিতে হয়। ঐতিহ্য রক্ষিত হয় তখনই, যখন নারী ঘোমটা টানিয়া গোমাতার ন্যায় ‘সুশীলা’ হইয়া উঠে। আর সে যদি প্রভাতে অঞ্জলি ভরিয়া গোমূত্র পান করিতে পারে, তাহা হইলে তো আর্যাবর্তে সুখের বন্যা ডাকিয়া যায়। ঐতিহ্যের এই পরম্পরা বহনে ভারতীয় পুরুষের কোনও ভূমিকা নাই, আছে নারীর। তাহাকে প্রয়োজন মতো খর্ব করিয়া এবং সুবিধা মতো তাহার সাফল্যকে ব্যবহার করিয়া সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখিতে হয়। সুতরাং হরিয়ানার কন্যারা যতই অলিম্পিকে পদক জিতুন এবং বিশ্ব ব্যাডমিন্টনে সম্মান লাভ করুন, তাঁহারা একটি যথার্থ অগ্রবর্তী সমাজের প্রতীক নহেন। ভারতীয় সমাজ তাহার সনাতন ঐতিহ্যে প্রোথিত হইয়া আছে, যে ঐতিহ্য মেয়েদের ঘোমটায় পিতৃতন্ত্রের অহংকে স্বস্তি দিয়া চলে।
কেন পিতৃতন্ত্র ইহাতে স্বস্তি পায়? কারণ, নারীকে পুরুষের ইচ্ছা মতো চালনা করিতে পারিলে, সমাজে পুরুষের পৌরুষ সহজে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। অপর দিকে, যদি নারীর সাপেক্ষে পুরুষ তাহার পৌরুষ প্রতিষ্ঠা করিতে না চাহে, তবে তাহাকে কেবল নিজের কৃতিত্ব ও কর্মের জোরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হইতে হইবে। যাহা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমের কাজ। আরও অনেক বেশি কঠিন পিতৃতন্ত্রের আদি ভাবনা হইতে মুক্ত করিয়া, নিজেকে অতিক্রম করিয়া নিজেকে কেবল নিজের সাপেক্ষে বিচার ও বিশ্লেষণ করা। নিজের আচরণকে প্রশ্ন করা এবং নিজের কাজের দায় লওয়া। তাহা করিলে, নারীর উপর কোনও দায় বা দোষ চাপাইয়া সমাজ কলুষিত হইতেছে না পুণ্য হইয়া উঠিতেছে, তাহার বিচার করা যাইবে না। কিন্তু সে অতি কঠিন সাধনা। এত কালের চিন্তার অচলায়তন হইতে নিজেকে বাহির করিয়া আনিলে পুরুষ বেপথু, অনিশ্চিত হইয়া পড়িবে। তাহার অস্তিত্ব সংকটে পড়িবে। তাহা অপেক্ষা অনেক সহজ নারীকে নিয়ন্ত্রণ করিয়া, প্রয়োজন মাফিক তাহার রাশ টানিয়া বা ছাড়িয়া পিতৃতন্ত্রের আদি ক্রীড়াটি বজায় রাখা। অতএব, ঘোমটাই পুরুষের স্থিতির একমাত্র অবলম্বন। হরিয়ানার বিজেপি সরকারের নিশানা নির্ভুল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy