Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শক্তির সংলাপ

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে কৃষ্ণ যখন শান্তির দূত হয়ে গিয়েছেন কৌরবসভায়, তখন কন্ব, নারদ গল্প শোনাচ্ছেন দুর্যোধনকে, অতীতে অতি-অভিমানের ফলে রাজাদের কী দুর্দশা হয়েছ, তার আখ্যান।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:১৫
Share: Save:

সন্ধ্যা হলে মেয়েরা টিভিতে বাংলা সিরিয়াল দেখে। নেহাত নিরীহ শখ, কিন্তু তা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শেষ নেই। মেয়েদের যে বুদ্ধি কম, কুঁদুলেপনা বেশি, শাড়ি-গয়না ছাড়া তারা কিছুই বোঝে না, সেই সব মহাসত্যগুলোয় নাকি মোটা আন্ডারলাইন করছে সিরিয়ালের নেশা।

অথচ অন্যের গল্প দেখে নিজেকে বুঝতে চাওয়ার ইচ্ছে অতি প্রাচীন। পাশা খেলায় হেরে বনে নির্বাসিত যুধিষ্ঠির বলছেন, আমার মতো মন্দভাগ্য ও দুঃখার্ত কোনও রাজাকে আপনি জানেন কি? তখন মহর্ষি বৃহদশ্ব তাঁকে শোনাচ্ছেন নল-দময়ন্তীর গল্প। ফের জয়দ্রথ দ্রৌপদী হরণের পর যুধিষ্ঠির বলছেন, আমার চেয়ে মন্দভাগ্য কোনও রাজা আছে কি? মার্কন্ডেয় শোনাচ্ছেন রামায়ণের গল্প। যুধিষ্ঠির নানা সংশয় প্রকাশ করছেন, প্রশ্ন করছেন, আর মুনিঋষিরা তাঁকে একের পর এক গল্প বলছেন, যা থেকে তিনি খুঁজে পান কর্তব্যের দিশা, আর তা পালন করার মতো মনের জোর। বুদ্ধদেব বসু লিখছেন, অরণ্য যেন এক বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে অনেক শিক্ষক, একটিই ছাত্র।

আবার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে কৃষ্ণ যখন শান্তির দূত হয়ে গিয়েছেন কৌরবসভায়, তখন কন্ব, নারদ গল্প শোনাচ্ছেন দুর্যোধনকে, অতীতে অতি-অভিমানের ফলে রাজাদের কী দুর্দশা হয়েছ, তার আখ্যান। কুন্তী কৃষ্ণকে দিয়ে বলে পাঠাচ্ছেন বিদুলা ও তাঁর পুত্র সঞ্জয়ের গল্প, যেখানে মায়ের বাক্যবাণে বিদ্ধ ছেলে যুদ্ধে উদ্যোগী হয়ে হৃতরাজ্য ফিরে পেয়েছিল।

জাতকের গল্প, পঞ্চতন্ত্রের গল্প, এগুলোও তো আদতে নৈতিকতার পাঠ, কর্তব্যের। যে কষ্ট আমার হচ্ছে তা কেমন করে সহ্য করব, যে সংশয় আমার হচ্ছে তা কেমন করে নিরসন করব, আমাকে যা মেনে নিতে বলা হচ্ছে তা ভাল না মন্দ, এমন যে সব দোলাচলে আমরা নিত্য আন্দোলিত হচ্ছি, কর্তব্য বুঝতে পারছি না, ভালমন্দ বুঝতে পারছি না, মুখে খুব জোর করে একটা কিছু বললেও মনে মনে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে, অন্যের থেকে আমরা তার শিক্ষা নিই। ভারতীয় দণ্ডবিধির বই খুলে দেখে যেমন কেউ কর্তব্য স্থির করে না। সে যুগেও মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ, প্রভৃতির সংহিতা, যেগুলি সামাজিক বিধিনিষেধ নির্দিষ্ট করে, অপরাধ ও তার শাস্তি নির্ধারণ করে, তা ক’জনই বা পড়েছিল? সেগুলি বিশাল ও জটিল, তাদের এক একটির বক্তব্য এক এক রকম, সেগুলোর মধ্যেও ক্রমাগত বিরোধ লেগে যায়। বরং দুই মহাকাব্য, পুরাণ, উপপুরাণ, এগুলির গল্প থেকে লোকে ধর্ম-অধর্মের ধারণা করেছে। এগুলিও ধর্মশাস্ত্র, বলছেন সুকুমারী ভট্টাচার্য।

টিভি সিরিয়ালে সাধারণত যা হয় একটু ওপর-ওপর, ভাল চলচ্চিত্রে বা সাহিত্যে তা আর একটু তলিয়ে দেখা যায়। তাই যদি তা সাধারণের বোধগম্য হয়, খুব জটিল বা অতিরিক্ত সফিস্টিকেটেড না হয়, তা হলে সেই সব গল্প আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে ওঠে। বিশেষ করে তখন, যখন তা আমাদের ছাঁচ ভাঙা চিন্তা করতে শেখায়। নিজের সম্পর্কে, সমাজে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের ধারণার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্ত্রীর পত্র’ বা আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ যে আমাদের ধাক্কা দিয়ে যায়, তার কারণ সেখানে এমন মেয়েদের গল্প রয়েছে যারা অন্যের ইচ্ছায় ঘাড় কাত করতে রাজি নয়। তাদের নিজেদের ভাল-মন্দ বিচার, ইচ্ছা-অনিচ্ছা দিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিতে চায়। তার জন্য মস্ত ঝুঁকি নিতেও তারা পিছপা হয় না। যা ছিল ‘পরিবারের ইজ্জত,’ এমন একটা গল্প তাকেই ‘স্বাধিকার’ বলে ভাবতে শেখায়। নিজের সঙ্গে নিজের, নিজের সঙ্গে জগৎ-সংসারের সম্পর্ক এক লহমায় বদলে যায়।

ভারতে এমন একটি মোড়-ঘোরানো ছবি কেতন মেহতার ‘মির্চ মসালা।’ এ বছর এই ছবিটির তিন দশক পূর্ণ হল। ছবিতে এক দরিদ্র মেয়েকে দাবি করে বসে এক অত্যাচারী পুরুষ, তাতে একটা গোটা গ্রামে মহা-সংকটের পরিস্থিতি তৈরি করে। গ্রামে এসে তাঁবু গেড়ে-বসা সুবেদারের নজর পড়ে গ্রামের মেয়ে সোনবাইয়ের উপর। গ্রামের অন্য মেয়েরা ছোটখাট গয়নার বিনিময়ে সুবেদারের তাঁবুতে যেতে আপত্তি করে না, সোনবাই কিছুতেই রাজি হয় না। উল্টে সুবেদার জোর করতে গেলে তাকে সপাটে চড় মেরে বসে। ক্ষিপ্ত সুবেদার গ্রামের মুখিয়াকে ডেকে বলে, সোনবাইকে তার হাতে তুলে দিতে হবে, নইলে গোটা গ্রাম তছনছ করবে সে। পঞ্চায়েত ডাকে মুখিয়া, সেই বৈঠকে গ্রামের লোক সিদ্ধান্ত নেয়, যেমন কর্ম তেমন ফল। সুবেদারকে চাঁটি মেরেছে, তার ফল ভুগতে হবে সোনবাইকেই। সোনবাইকে সুবেদারের হাতে তুলে দেওয়া হোক। সোনবাই তাতে রাজি হয় না। গ্রামের মুখিয়া তাকে বলে, তোমার স্বামীকে আমরা বুঝিয়ে বলব, তুমি যাও। সোনবাই বলে, ‘আমার মরদ এসে যদি আমাকে যেতে বলে, তবুও যাব না।’

ভারতীয় সিনেমাতে সম্ভবত এটাই সব চাইতে শক্তিময়ী সংলাপ, যা আমরা একটি মেয়ের জবানে শুনি। যেখানে একটি মেয়ের প্রতিপক্ষ সুবেদার, মুখিয়া, গোটা গ্রাম, এমনকী গ্রামের মেয়েরাও, কারণ সেই মুহূর্তে নিজেদের সম্ভাব্য বিপদের কথা চিন্তা করে তারাও সুবেদারের কাছে সোনবাইকে পাঠাতে চায়। একটি মেয়ে তাকে বলে, ‘আমি ওর সঙ্গে শুয়ে গয়না পেয়েছি, তুমি এমন কে যে রাজি হচ্ছ না যেতে?’ এরা সকলেই মনে করে, একটি মেয়ের যৌনতার উপর অধিকার স্বামীর, পরিবারের, এবং তারপর গ্রামের। তাদের আপত্তি না থাকলে মেয়েটি আপত্তি করার কে? এই চিন্তা গ্রাম্য মেয়েদের ক্ষুদ্রবুদ্ধি-প্রসূত, এ কথা ধরে নিলে ভুল হবে। সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখছেন, মহাকাব্য ও পুরাণে বহু কাহিনিতে অতিথিদের আমোদের জন্য গৃহিণীকে বা কুমারী কন্যাদের দান করা হত।

আমরা সাংবাদিক হিসেবে এমন অনেক খবর পাই, যাতে একবিংশেও এই ধারণার প্রচলন কতখানি, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। বালিকা বা কিশোরী যখন বাবা-কাকাদের অত্যাচারে হাসপাতালে ভর্তি, তখন আমাদের বলা হয়, এটা পারিবারিক ব্যাপার। যখন শ্বশুর-দেবরের নির্যাতনে বিপন্ন বধূ ধর্ষণের অভিযোগ আনে, তখন তাকে বদনাম দিয়ে তাড়ানো হয়, নইলে ধমক দিয়ে চুপ করানো হয়। আমরা ভুলিনি উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে ইমরানার ধর্ষণকাণ্ড। নিজের শ্বশুরের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার পর গ্রামের পঞ্চায়েত বলে, ইমরানার বিবাহ আর বৈধ নয়, এখন স্বামীকে সন্তানসম দেখতে হবে ইমরানাকে। ইমরানা নিজে যে শ্বশুরের সঙ্গে সম্পর্ক চায়নি, বিবাহ করা দূরের কথা, সে কথাটা গ্রামের মানুষের বিবেচনাতেই স্থান পায় না। পাঁচ সন্তানের মা ইমরানা তা মেনে নিতে রাজি না হলে এ বিষয়ে ফতোয়া জারি করে দারুল উলুম দেওবন্দ। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ অবধি সেই ফতোয়াকে সমর্থন করেন। শেষে মিডিয়া লেখালেখি করলে জাতীয় মহিলা কমিশনের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয় শ্বশুরকে।

আবার কলকাতারই হিন্দু পরিবারের এমন একটি ঘটনার কথা জানি, যেখানে ধর্ষণের মামলার পর ‘ধর্ষিতা’ তরুণীকে পরীক্ষা করতে গিয়ে আমার এক ডাক্তার বন্ধু দেখেন, সে সাত-আট মাসের গর্ভবতী। প্রশ্ন করে জেনেছিলেন, এতদিন ধর্ষকের সঙ্গে তার বিয়ের দরদস্তুর চলছিল। শেষ অবধি মতের মিল না হওয়ায় ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এমন ভাবে আমরা বেশ কিছু ঘটনার কথা শুনেছি, যেখানে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিয়ে দরদস্তুর চলে, এবং বোঝাপড়া না হলে ধর্ষণের মামলা হয়। বিয়ে বা ক্ষতিপূরণ, কোনও বিষয়েই মেয়েটির বক্তব্য কেউ জানতে চায় না।

এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে তিরিশ বছর আগে তৈরি হওয়া ‘মির্চ মসালা’ ছবিতে দেখি গ্রামের এক দরিদ্র বধূকে, যে সবার সামনে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দেয়, কারও কথা সে শুনবে না। মুখিয়া বা তার নিজের স্বামী, কারও অধিকার নেই তাকে যৌনসম্পর্কে বাধ্য করার। একা একটা কাস্তে হাতে সোনবাই শেষ অবধি মুখোমুখি হয় সুবেদারের।

ছবির শেষ দৃশ্যে গ্রামের মেয়েরাই অপ্রত্যাশিত ভাবে এসে দাঁড়ায় সোনবাইয়ের পাশে। লঙ্কা গুঁড়িয়ে যে মশলা তারা তৈরি করেছে, সেই মির্চ মশালার রাশি তারা ছুটে এসে বার বার ছুড়ে দিতে থাকে সুবেদারের চোখেমুখে। যন্ত্রণায় কাতর সুবেদার ছটফট করতে থাকে সোনবাইয়ের পায়ের কাছে। লাল আবিরের মতো উড়তে থাকা লঙ্কার গুঁড়োর মধ্যে দিয়ে দেখা যায় সোনবাইয়ের মুখ, তার শক্ত চোয়াল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, তার দাঁড়িয়ে থাকার অটল ভঙ্গীটি। এ কাহিনিতে নারী পুরুষের প্রহরণ ধারণ করেনি, যা তার সাংসারিক সামগ্রী, যা তার নিত্য ব্যবহার্য, তার নিজের হাতে প্রস্তুত, তেমন জিনিসকেই অস্ত্র করে সে প্রতিপক্ষকে পরাহত করেছে, তার দর্পচূর্ণ করেছে। এটা কাহিনিকে যেমন বিশ্বাসযোগ্য করেছে, তেমনই যেন একটা ইঙ্গিত দিয়েছে যে পুরুষের সঙ্গে যুঝতে নারীর পুরুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। পুরুষের শর্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রয়োজন নেই। নিজস্ব শক্তি, নিজের প্রকৃতিজাত শক্তিতেই সে পরাজিত করতে পারবে পুরুষকে। বস্তুত, এই শেষ দৃশ্যটি যেন গত বছর মুক্তি-পাওয়া সুজিত সরকারের ‘পিংক’ ছবিটি থেকে একটু এগিয়েই রাখে তিরিশ বছরের পুরনো ‘মির্চ মসালা’ ছবিটাকে, কারণ সেখানে মর্যাদার যুদ্ধ জয় করে আধুনিক, রোজগেরে মেয়ে মৃণাল ব্যারিটোন-কণ্ঠী পুরুষ আইনজীবীর হাত ধরে সক্রন্দনে ‘ধন্যবাদ’ বলে। মেয়েদের সক্ষমতার স্ক্রিপ্ট লিখতেও এক জন জাঁদরেল পুরুষ চাই, এই ধারণাটা শেষ কালে একটু ধাক্কা দিয়ে যায়।

মির্চ মসালা ছবিটি সেখানে ইঙ্গিত দেয়, প্রয়োজন আরও অনেক মেয়েকে নিজের পাশে নিয়ে আসার। প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে একটি মেয়ের বেরিয়ে আসার অবিশ্বাস্য ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখে বহু মেয়ে বেরিয়ে আসে, পাশে দাঁড়ায়, লড়াই করে। নির্ভয়া কাণ্ডের পরে দিল্লিতে, কামদুনি কাণ্ডের পরে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে আমরা সাধারণ পরিবারের সাধারণ বধূ-কন্যাদের বেরিয়ে এসে দাঁড়াতে দেখেছি। তারা ইজ্জত আর শরমের পুরনো সংলাপ থেকে বেরিয়ে এসেছে, রাষ্ট্রের কাছে মেয়েদের অমর্যাদার বিচার দাবি করেছে। এ ভাবে আমাদের চারদিকে প্রতিদিন তৈরি হয়ে চলেছে নতুন নতুন গল্প। সেগুলো যেন সাইনবোর্ড, বা সিগন্যাল। তা দেখে নতুন পথ খুঁজে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ মেয়ে। বদলাচ্ছে সমাজের মানচিত্র।

সিরিয়ালই হোক আর সংবাদই হোক, মেয়েরা জানে শক্তির সংলাপ, সক্ষমতার চিত্রনাট্য। ওদের টিভি দেখার ‘ব্যাড হ্যাবিট’ শোধরানোর চেষ্টা করবেন না। নিজের চা নিজে করে নিন।

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Women dialogues Serials Movie Social Value
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE