Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ছায়াবৃত্তে আটকে নারীশিক্ষা, হোঁচট লাগে লিঙ্গ বৈষম্যেও

জাতীয় শিক্ষানীতি পাঠ্যক্রমে লিঙ্গবৈষম্য বিলোপের কথা বলেছে। আজ অবধি সেই সাম্য প্রতিষ্ঠার উপর তেমন ভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। লিখছেন লিপিকা বিশ্বাস সাহাজাতীয় শিক্ষানীতি পাঠ্যক্রমে লিঙ্গবৈষম্য বিলোপের কথা বলেছে। আজ অবধি সেই সাম্য প্রতিষ্ঠার উপর তেমন ভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। লিখছেন লিপিকা বিশ্বাস সাহা

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৯ ০২:৫৮
Share: Save:

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার পরে, নয় বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই অনেক অভিভাবক মেয়েদের আর কাছের কোএডুকেশন স্কুলে পাঠায় না। গ্রামাঞ্চলে ৪০% মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়। একশো জনে মাত্র এক জন দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে।

এ-ও স্বীকার না করে উপায় নেই যে নারী শিক্ষকের অভাব আছে। পশ্চাৎপদ এলাকায় অধিকাংশ সময়ে নারী শিক্ষক পাওয়া যায় না— চাকরি পেয়েও অনেকে যেতে চান না অথবা বদলি নিয়ে শহরে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকের পদ খালি থেকে যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। কিন্তু তাঁদের অনুপাত পুরুষের তুলনায় খুবই কম। শিক্ষাক্ষেত্রে মহিলা কর্মকর্তার অভাব থাকায় পুরুষতান্ত্রিক প্রভাবও আগাগোড়া বজায় রয়েছে। নারীদের অজ্ঞতা, মা-কন্যা-স্ত্রী হিসেবে বাড়ির গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে দেখার মানসিকতা এবং বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের অভাব মনস্তাত্ত্বিক বাধা তৈরি করে। অনেকেই চিরাচরিত ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন না।

আশু প্রয়োজন, ত্রুটিপূর্ণ পাঠ্যক্রম সংশোধন ও নারী শিক্ষা নীতির আধুনিকীকরণ। সংবিধানে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠিত তবু প্রচলিত পাঠ্যক্রমের ছত্রে-ছত্রে লিঙ্গবৈষম্য স্পষ্ট। মেয়েদের গৃহকর্ত্রী, গৃহকর্মে নিপুণা, স্ত্রী এবং মা হিসাবে চিত্রিত করা হয় পাঠ্যপুস্তকে। কিছু কিছু রাজ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিতকে একটি বিকল্প বিষয় হিসাবে দেওয়া হয়। প্রচলিত বইয়ে মেয়েদের নিষ্ক্রিয়, ভিতু, অক্ষম, পরিবারের উপর নির্ভরশীল, উপার্জনহীন হিসাবে দেখানো হয়। পক্ষান্তরে ছেলেদের উপার্জনক্ষম, সাহসী, সক্ষম, সর্বকাজে পারদর্শী হিসাবে দেখানো হয়।

জাতীয় শিক্ষানীতি (এনপিই) ১৯৮৬-তে বলা হয়েছে, শিক্ষা হবে সকলের জন্য এবং নিদিষ্ট ধাপ পর্যন্ত সমমানের শিক্ষা লাভ করবে সকলে। পাঠ্যক্রমে লিঙ্গবৈষম্য বিলোপের কথাও বলা হয়। তবুও আজ অবধি সেই সাম্য প্রতিষ্ঠার উপর তেমন ভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি।

প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘‘দেশের চরিত্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নির্ণায়ক সূচক নারীর মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান ভিন্ন অন্য কিছু নয়।’’ তাঁর প্রত্যয় ছিল, ভারতের অগ্রগতির পরিমাপ হবে দেশের নারীর উন্নয়নের নিরিখে। কিন্তু তা যে মেয়েদের শিক্ষা ব্যতীত কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে এখনও ২১.৯% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করেন। গ্রামে-গঞ্জে দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা আজও অতি অল্প বয়সেই ভোগের বাজারে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়ে যায়। যে বয়সে তাদের মা-বাবার আশ্রয়ে নিরাপদে বেড়ে ওঠার কথা, শিক্ষার অঙ্গনে এসে বহির্বিশ্বের জ্ঞান লাভ করার কথা, সেই বয়সে দৈনিক হাতবদল হয় সে। ক্রীতদাসী হিসেবে শ্রম বা যৌন বাজারে তাদের নিয়ে চলে বিকিকিনি। যাদের ভাগ্য এতটা খারাপ নয়, তাদেরও পেট ও পরিবার চালাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিশু শ্রমিক হিসেবে পরিচারিকার কাজ, ইটভাটায় কাজ, কাগজ কুড়ানির কাজ বা নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়। ছোট্ট মেয়ের ছোট্ট-ছোট্ট হাত বই ধরার বদলে পরিবার নামক গাড়ির জোয়াল কাঁধে বয়ে চলে। নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকায় দরিদ্র পরিবারের মেয়ের বিয়েতে অন্যতম যোগ্যতামান হল সে বিড়ি বাঁধতে জানে কি না! অক্ষরজ্ঞান সেখানে গৌণ।

বর্তমানে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে বালিকা শিক্ষার উন্নয়নে সচেতন চেষ্টা শুরু হয়েছে। শিক্ষার অধিকার আইনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব মেয়ে বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকারী। পতনশীল যৌন অনুপাতের মোকাবিলা করতে এবং নারীশিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ কর্মসূচির সূচনা করেন ২২ জানুয়ারি, ২০১৫। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে এই কর্মসূচির ধারণাটির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। বেশ কিছু রাজ্য সরকার মেয়ে শিশুর জন্য বিনামূল্যে শিক্ষাদান, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, সুকন্যা সমৃদ্ধি পরিকল্পনা ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করেছে। বিতর্ক যাই থাক, আমাদের রাজ্যে কন্যাশ্রী প্রকল্প, সবুজ সাথী প্রকল্পের মাধ্যমে সাইকেল দেওয়ার ফলে গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের অষ্টম শ্রেণির পরেও স্কুলমুখী থাকার প্রবণতা নিশ্চিত ভাবে বেড়েছে।

আশার কথা, ডিজিটাল ভারতে নাগরিক চরিত্র গঠন, দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং সামাজিক সংস্কারে নারীর গুরুত্ব উপলব্ধি করা হচ্ছে। সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত সাম্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারীশিক্ষায় মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। কেননা ছায়াবৃত্তের মধ্যেই যদি নারীর অবস্থান হয়, অগ্রগতি নামক সূর্যোদয় কোনও দিনই দেখা সম্ভব নয়।

শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gender Equality Women's Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE