Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শুধু হাসালে হবে না, লজ্জিত হতেও জানতে হবে

কিছু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, শিক্ষিকাদের অনুরোধেই নাকি শৌচাগারে বসেছে মার্বেল, সুন্দর আয়না। ব্যস, পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভাবনার শেষ এখানেই। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামকিছু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, শিক্ষিকাদের অনুরোধেই নাকি শৌচাগারে বসেছে মার্বেল, সুন্দর আয়না। ব্যস, পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভাবনার শেষ এখানেই। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলাম

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৯ ০০:৫৫
Share: Save:

প্রশ্নটা অসুখে নয়। শরীর থাকলে অসুখ থাকবেই। তার চিকিৎসাও আছে। প্রশ্নটা অসুখের শ্রেণিবিন্যাসে, স্ত্রী–পুরুষ বিভাজনে। সমাজ ও পরিবারে বৈষম্যের সামনে দাঁড়িয়ে সব মেয়েদের জীবন একরকম দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। এ একেবারে চেনা কথা। পৃথিবী জুড়ে এই বিভাজনে ইতি টানতে লড়াই করছে মেয়েরা। কিন্তু চেতনার কি বদল হচ্ছে? বাড়িতে অনুষ্ঠান, অসুখ, জমি রেজিস্ট্রি, গৃহপ্রবেশ— সব কিছুতেই মেয়েদের বাড়তি ছুটি নিতে হয়। এটাই প্রত্যাশিত। প্রায়ই মেয়েদের শুনতে হয়— ‘বাবুর জ্বর, আজ কি স্কুলে না গেলেই নয়!’ শাশুড়ি-শ্বশুর অসুস্থ। প্রথম ছুটি নেওয়ার দায় বাড়ির বৌমার উপরে। নইলে শুনতে হয়, ‘এক দিন স্কুল না গেলে কী এমন পৃথিবী উল্টে যাবে শুনি! তুমি কি একাই চাকরি করছ?’ আবার অনেক সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে বলা হয়, ‘তোমার বাছা চাকরির বড্ড অহঙ্কার! অমুকের বৌমা তো ব্যাঙ্কে চাকরি করেও সময় পায়।’ সেখানেও প্রচ্ছন্ন খোঁটা (অর্থাৎ, তুমি স্কুলে পড়াও। এত কথা কিসের)!

অনেকে বলতেই পারেন— ‘আপনারা করেন কেন? শিক্ষিকাদের রান্না করে বিদ্যালয় যেতে কে বলেছে? সংসারের যাবতীয় কাজ করে তার পরে স্কুলে যাওয়ার নির্দেশ কে কবে দিল আপনাদের? এ তো আপনাদের নিজেদের একান্ত সাংসারিক বোঝাপড়ার ব্যাপার। মন্ত্রীমশাই না হয় ‘স্ত্রীরোগ’ বলে ফেলেছেন। তাতে এত হাঙ্গামার কী আছে?’

ঠিক। মেয়েদের কেউ এমন নির্দেশিকা হাতে ধরিয়ে দেয়নি। জন্মসূত্রে উপহার দিয়েছে শুধু পরিস্থিতি। বিনা রক্তপাতে এক নীরব যুদ্ধ চলে প্রতিদিন। এ কথা ঠিক অসুখ যার, বদলি তারই হবে। সুবিধার শর্তের ভুল ব্যবহার হবে না। কিন্তু জনসমক্ষে আজকের উচ্চারিত স্ত্রীরোগকে বদলির হাতিয়ার বানাতে সাহায্য করেছেন কারা? এই তরজা জরুরি। এই বহু চর্চিত স্ত্রীরোগের দোহাই দিয়ে কত সুস্থ মানুষ ড্যাং ড্যাং করে বাড়ির কাছে বদলি নিয়ে গর্বিত মুখে ঘুরছেন— সে দায় কার? শুধু হাসালেই হবে না, লজ্জিত হতেও জানতে হবে! সেটা মানতে পারলে সংশোধনের পথ খোলা থাকে। ভুলে ভরা ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আনা যায়। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে ‘জেনুইন’ ঘাঁটার নৈতিক অধিকার কি হাতের মুঠোয় ধরে রাখা যায়?

সবচেয়ে মজার কথা হাইস্কুলের বদলির ক্ষেত্রেও এই স্ত্রীরোগ নিয়ে এক রকমের অনিয়ম হয়েছে। সেখানে প্রেগন্যান্সি থেকে অনিয়মিত ঋতুকে দুরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এমনকি স্বামী–স্ত্রী দূরে থাকায় সন্তানলাভের অসুবিধার কারণ দেখিয়েও কাছে বদলির আবেদনপত্র জমা পড়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় রোগ বলে যা নির্বাচিত হয়েছে তা হল এলাকার সাংসদ ও বিধায়কদের সুপারিশ বা রফা হওয়া আর্থিক লেনদেন। বদলির ইতিহাসে এটা কিন্তু ‘জেনুইন’ ঘটনা।

কমবেশি সব মহিলার হিমোগ্লোবিন, ক্যালসিয়াম, আয়রনের অভাবজনিত সমস্যা থাকে। সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ফলে নানা রকম শারীরিক জটিলতা পেরোতে হয় মেয়েদের। ঋতু কোনও শারীরিক অসুখ নয়। একটি প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে অনেক ‘ডিসর্ডার’ জড়িয়ে থাকে। তারও চিকিৎসাও আছে। মূল প্রশ্ন হাইজিনের। সেটা ভাল ভাবে দেখা হয় না। সেটার দায় নিশ্চিত বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা উপেক্ষিত থাকে। অন্য দিকে বিদ্যালয়ের রং নীল–সাদা করার এক ‘আনঅফিসিয়াল’ চাপ থাকলেও পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের ব্যাপারে কেউ রা কাড়ে না। কিছু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, শিক্ষিকাদের অনুরোধেই নাকি শৌচাগারে বসেছে মার্বেল, সুন্দর আয়না। ভাবনার শেষ এখানেই। মেয়েদের নিয়ে হাইজিনের ধারণা সমাজের সব স্তরেই কমবেশি এক। মেয়েদের সবসময় এ ব্যাপারে আপস করে চালাতে হয়। এটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছে। আর এই সব নানা কারণে মেয়েদের ইউটিআই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

আসলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাবোধ শেখানোর দায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষিকাদেরই। বিদ্যালয় থেকেই তুমুল প্রচার দরকার। কিন্তু সেখানেই শিক্ষিকারা একটা পরিচ্ছন্ন শৌচাগার পান না। নেই কোনও জল সঞ্চয় করে রাখার বাড়তি ব্যবস্থা। বিদ্যালয়ের কোনও শৌচাগারেই ‘ফেমিনাইন হাইজিন বিন’ নির্মাণ হয় না। নেই স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা। বই– ব্যাগ-খাতা-সাইকেল–পোশাক বিনা মূল্যে দেওয়া হলেও শিক্ষিকা তো দূরের কথা ছাত্রীদের জন্যও কখনও ভাবা হয়নি স্যানিটারি ন্যাপকিনের কথা। বৈষম্যের মোটা দাগ বরাবর নজর এড়িয়েছে এ ভাবেই।

ভুল ধারণাকে প্রশ্রয় দিয়ে কখনও কোনও বড় কাজ হয় না। মানুষের সমস্যাকে উপলব্ধি না করলে মুখ থেকে এমন কথা বেমালুম বেরিয়ে আসে যা কখনও ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। এ হল রাজনীতির সবচেয়ে বড় দায়। দরকার মানুষের ভাবনার বদল ঘটানো। মেয়েদের সমস্যাকে মানুষের সার্বিক সমস্যা হিসেবে না ভাবতে শিখলে হাততালি পড়ে ঠিকই কিন্তু ইতিহাস সেই লজ্জা মনে রাখে। এই লজ্জা কোনও এক জন মন্ত্রী বা দফতরের নয়, এই অসুখ মহামারির মতো রাজনৈতিক ক্ষেত্র ছেয়ে ফেলেছে।

মহিলাদের অপমান করার পরে মর্মাহত হওয়ার কোনও মানে হয় না। জনপ্রতিনিধি শব্দটার সঙ্গে এ ভাবে প্রতারণা করার অধিকার নেই কারও। তাতে মর্মাহত হয় সেই বিশাল সংখ্যক মানুষ যারা নির্বাচিত মানুষের মনের গভীরতা মাপতে ভুল করে। কিন্তু তার পরেও প্রত্যাশার চাদর বিছিয়ে রাখে। সেখানে এক দিন অভিশাপের মতো আছড়ে পড়ে ক্ষমতার দম্ভ। ‘দেখব’ —এই বিনয়ের পাশে লুকিয়ে থাকে অচেনা হুমকি। দেখার সীমানা কি সত্যিই এতটা বিস্তৃত করার অধিকার জনগণ তুলে দেয়? হয়তো মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বিড়বিড় করতে থাকে অন্য কোনও কণ্ঠ—‘কী দেখবেন স্যর! আমরাও দেখব! সব দেখার ক্ষমতা এক দিন আমরাই তুলে দিয়েছিলাম। এক দিন আমরাই তা কেড়ে নেব। মার্জনা করবেন, সে দিন আপনিও দেখবেন স্যর!’

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Women Job
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE