Advertisement
১১ মে ২০২৪

সুস্থ শৈশবের জন্য জরুরি বিস্মৃত লোকক্রীড়ার চর্চা

‘লোকক্রীড়া’ বলতে সাধারণত গ্রামীণ খেলাধুলোকেই বোঝায়। এক সময়ে সারা বাংলা জুড়ে নানা বিচিত্র খেলা প্রচলিত ছিল। এখন চর্চার অভাবে, অনেক খেলার নামও পর্যন্ত গ্রামের মানুষ ভুলতে বসেছেন। ছোটরা এখন মোবাইলেই ব্যস্ত। লিখছেন অমর চট্টোপাধ্যায়‘লোকক্রীড়া’ বলতে সাধারণত গ্রামীণ খেলাধুলোকেই বোঝায়। এক সময়ে সারা বাংলা জুড়ে নানা বিচিত্র খেলা প্রচলিত ছিল। এখন চর্চার অভাবে, অনেক খেলার নামও পর্যন্ত গ্রামের মানুষ ভুলতে বসেছেন। ছোটরা এখন মোবাইলেই ব্যস্ত। লিখছেন অমর চট্টোপাধ্যায়

চলছে কিত-কিত খেলা। —ফাইল ছবি।

চলছে কিত-কিত খেলা। —ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:২৩
Share: Save:

বয়স বাড়লে স্মৃতিরা এসে ভিড় করে। সেই স্মৃতির মালায় শৈশবের ফুলগুলি জ্বলজ্বল করে। আর শৈশব মানেই তো নানা খেলার সমারোহ। গ্রামের দিকে, এখন যাঁদের বয়স পঞ্চাশের উপরে, তাঁদের শৈশবের কথায় বার বার ফিরে আসে নানা লোকক্রীড়ার কথা। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় বিনোদনের সেই আয়োজনগুলি এখন বিলুপ্তির পথে। অথচ, তারা এক দিন গ্রামীণ সমাজের শৈশবের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল।

‘লোকক্রীড়া’ বলতে সাধারণত গ্রামীণ খেলাধুলোকেই বোঝায়। এক সময়ে, সারা বাংলা জুড়ে নানা বিচিত্র খেলা প্রচলিত ছিল। আবার অঞ্চলভেদে একই খেলার নাম এবং তার নিয়মকানুনও বদলে যেত। এখন চর্চার অভাবে, অনেক খেলার নামও পর্যন্ত গ্রামের মানুষ ভুলতে বসেছেন। কিন্তু এমন দিনও ছিল, যখন পড়াশোনার পাশাপাশি, অবসর সময়ে কমবয়সী ছেলেমেয়ে বা যুবসম্প্রদায় এই খেলাগুলি নিয়ে মেতে থাকত। হইচই আর দুরন্তপনায় মাতিয়ে তুলত পাড়া। গ্রামে বড় হয়ে উঠেছে এমন ছেলেমেয়েরা হা ডু-ডু, কিত-কিত, মার্বেল, লাটিম কিংবা ডাংগুলি খেলেনি, এমন দৃষ্টান্ত বিরল।

হা ডু-ডু ও কিত-কিত প্রায় এক জাতীয় খেলা। আধুনিক কবাডির সঙ্গে এর যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আগে গ্রামে গ্রামে এমন খেলাকে কেন্দ্র করে উৎসাহ, উদ্দীপনা তুঙ্গে উঠত। বসত প্রতিযোগিতার আসর। এখন সেখানে ভাটার টান। লাঠিখেলা শরীরচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত এক ধরনের লোকক্রীড়া। তখনকার দিনে মনসার ভাসান, কিংবা দুর্গাপুজোর বিসর্জনের সময় সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে লাঠিখেলার নানা কৌশল উপভোগ করত। মফস্সলের আরও একটি জনপ্রিয় খেলা ছিল ধাপসা বা গেমঘর। দলবদ্ধ এই খেলায় পরিশ্রম ভালই হত। আজকের যুগে অবশ্য এই খেলার কোনও অস্তিত্বই নেই। এ ভাবেই হারিয়ে গিয়েছে ঝরোল ঝাঁপ, বুড়ি ছোঁয়া, চোর-পুলিশের মতো খেলাগুলিও। গরু চরাতে গিয়ে, নিস্তব্ধ দুপুরে, একটু জিরিয়ে নেওয়ার ফাঁকে গাছের তলায় বসে মাটিতে ছক কেটে ষোলোঘুঁটি, ছাঁতপাত কিংবা বাঘবন্দি খেলার দৃশ্য তখন হামেশাই দেখা যেত। এখন তা বেশ বিরল।

শীতের মরসুম এলেই, ধান কাটার পরে, নেড়া মাঠের উপর দিয়ে খালি পায়ে ছুটতে ছুটতে ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দই ছিল আলাদা। স্কুলে যাওয়া ছেলেদের কারও কারও হাফপ্যান্টের এক পকেটে থাকত লাট্টু-দড়ি, অন্য পকেটে মার্বেল। সেই সময় এ সব নিয়ে শিক্ষকদের হাতে ধরা পড়লে শাস্তি পেতে হত। স্কুল ছুটির পরে, মনের আনন্দে সেই লাট্টু ঘোরাতে ঘোরাতে বাড়ি ফিরত সেই সময়ের ছোটরা। আর ছিল ডাংগুলি খেলা। ডাংগুলিতে আঘাত লাগার আশঙ্কা ছিল। বিশেষ করে চোখে। তাই বড়রা খেলতে নিষেধ করতেন। আজও এ সব কথা গ্রামের অনেক বয়স্ক মানুষকে স্মৃতিমেদুর করে তোলে।

তখন গ্রামের বাড়িগুলিতে টিভি তো দূরের কথা, রেডিয়োর দেখা মিলত না। হয়তো পাঁচখানা গ্রাম ঘুরলে, একটি বর্ধিষ্ণু পরিবারে দেখা মিলত ঢাউস মাপের একখানা রেডিয়োর। গৃহস্থ বাড়ির অনেক মহিলাকে দেখা যেত দুপুরের খাওয়ার পরে কড়ি খেলে সময় কাটাতেন। আজকের দিনে সে সব অচল। দুই দশক আগে, তখনও স্মার্টফোনের যুগ আসেনি, পড়ন্ত বিকেলে চণ্ডীমণ্ডপের চত্বর জুড়ে শোনা যেত উঠতি বয়সের কিশোরকিশোরীদের কথাবার্তা। একটা দল লুকোচুরি খেলায় মত্ত, তো অন্য দলের ছেলেমেয়েরা এক জনের চোখ বেধে দিয়ে তার মাথায় টোকা মারতে মারতে বলছে, ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ’। এই সব খেলাধুলোর সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে এক্কা-দোক্কা, ইকিড়-মিকির, ফুলপাখি ইত্যাদি খেলাগুলিও।

আগে অনেকে অভিযোগ করতেন, এই খেলাগুলি নিছকই বিনোদন। কোনও ধরনের শিক্ষা এই সব খেলা থেকে মিলত না। কিন্তু, এই সব খেলার মধ্যে দিয়ে ছোটরা এক সঙ্গে কোনও কিছু করার শিক্ষা পেত। নিজেদের মধ্যে সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠত। দল বেঁধে কোনও কিছু করার প্রবণতা তৈরি হত। পরে কোনও সামাজিক উদ্যোগে যৌথ ভাবে এগিয়ে যেতে যা সহায়তা করত।

কিন্তু এখন আমাদের শিশুরা এই সব খেলাগুলির জায়গায় মোবাইলে ব্যস্ত। আজকে শহরের শিশুরা তো বটেই, গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে ইন্টারনেট ও মোবাইল গেমে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এ সব খেলার মধ্যে দিয়ে ছোটরা শৈশব থেকেই কম্পিউটার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। যা তাদের ভবিষ্যতে কাজকর্মে সুবিধা করে দিতে পারে। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মোবাইল বা ইন্টারনেট মাধ্যমেই ব্লু-হোয়েল, মোমোর মতো মারণখেলা ডালপালা বিস্তার করে চলেছে। পাশাপাশি, এক সঙ্গে খেলার মধ্যে দিয়ে যে দলবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয় তাও হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের শিশুদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে একা থাকার, একাই ভোগ করার প্রবণতা। ভবিষ্যতে যা থেকে জন্ম নিচ্ছে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা বোধ। কোনও সামাজিক উদ্যোগে এক সঙ্গে এগিয়ে আসার প্রবণতাও কমেছে। আর বাড়িতে বসে মোবাইলে মেতে থাকা শিশুদের সে ভাবে শরীরচর্চাও করা হয় না। ফলে, শৈশবেই স্থূলতার সমস্যা বাড়ছে। শিশুদের মানসিক বিকাশও বাধা পাচ্ছে। তাই সময় এসেছে, হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলিকে নিয়ে নতুন করে ভাবার। আজ এর সেই গ্রামীণ পরিবেশ নেই। ফলে স্কুলস্তর থেকেই ভাবনাটা শুরু হওয়া দরকার।

লেখক চাকদোলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mobile game
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE