ভাইচুং ভুটিয়া, সঞ্জীব গোয়েন্কা কিংবা মুহাম্মদ ইউনূস, তিন জনই নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ডি লিট দিবার জন্য এই নামগুলি এ বৎসর বাছিয়া লইয়াছেন। পর পর দুই বাক্যের মধ্যে সম্পর্কটি খুব স্পষ্ট নহে, কিন্তু ইহাই বাস্তব, তাই এই বাক্যবিন্যাস অসঙ্গতিময় বলা চলে না। অবশ্য এই তিন জনের এক জন ইতিমধ্যেই উপাধি স্বীকারে অরাজি হইয়াছেন, বাকিরাও এখনও নিশ্চিত স্বীকৃতি জানান নাই। এই সূত্রেই আরও কতকগুলি নাম শোনা যাইতেছে, যথা মুকেশ অম্বানী, কিংবা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁহারাও নিজেদের ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয়। সম্ভবত ইঁহারা সকলেই বিস্মিত বোধ করিতেছেন, কেন এই বিশেষ প্রেক্ষিতে তাঁহাদের নামগুলি উঠিয়া আসিল তাহা ভাবিয়া। তাঁহাদের কর্মজগতের সহিত সারস্বত চর্চার তো তেমন সম্পর্ক নাই! সচরাচর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্মানিত করিবার জন্য সারস্বত বিদ্যাচর্চার সহিত যুক্ত ব্যক্তিদের কথাই ভাবিয়া থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই উত্তরটি জানেন, কিন্তু অন্যান্যদের পক্ষে ধাঁধাটি কিছু কঠিন।
ডি লিট তালিকা প্রস্তুত হইয়াছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক সমাবর্তন অনুষ্ঠান উপলক্ষে। এ প্রসঙ্গে দুইটি কথা উল্লেখ্য। এক, ডি লিট যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান, প্রতি বৎসর যে বাধ্যতামূলক ভাবে এই সম্মান দিতেই হইবে, এমন নহে। দুই, প্রতি বৎসর সমাবর্তন হয় ঠিকই, কিন্তু প্রতি সমাবর্তনেই ডি লিট অর্পণের বাধ্যতা নাই। সুতরাং উপযুক্ত সারস্বত নামের অভাবে ভিন্ন পথে ভাবিতে হইল, এমন যুক্তি টেকে না। তবে আর একটি কথা আছে। সম্পূর্ণ পরিকল্পনায় একটি মনোভঙ্গির পরিচয় মেলে, যাহা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রমের সঙ্গে বিনোদন ও জনমনোরঞ্জনের মেলবন্ধনে বিশেষ উৎসুক। এই তিন নম্বর কথাটি কিছু অস্বস্তি তৈয়ারি করে। মনে পড়িয়া যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যের বিবিধ আচরণে গভীর রাজনৈতিক দলান্ধতার ছায়া। প্রস্তাবিত ডি লিট তালিকার মধ্যেও কি সেই দলানুগামিতার ছায়া প্রকট নয়? ‘সরকারি’ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, ‘বঙ্গ’ পুরস্কার বিতরণে, বিবিধ উৎসবে বিনোদন ও ক্রীড়াজগতের তারকাদের যে উজ্জ্বল উপস্থিতি, যাদবপুরের সমাবর্তনেও কি তাহার প্রতিফলন?
উপাচার্যরা আসিবেন যাইবেন, কালের কপোলতলে ভাসিবেন, কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাহার নিজস্ব ইতিহাস লইয়া চলিতে থাকিবে। সেই ইতিহাসে অগৌরব উৎকীর্ণ হইলে কিন্তু অভিজিৎ চক্রবর্তীর দোহাই দিয়া তাহাকে মুছিয়া ফেলা সম্ভব হইবে না। এই মৌলিক কথাটি মনে রাখিতেছেন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য আধিকারিক ও ছাত্রসমাজ? বিশ্ববিদ্যালয় কেবল উপাচার্যের নহে, তাঁহাদের সকলের। প্রতিবাদ-বিহীনতার অবকাশে, তাঁহাদের সকলের প্রচ্ছন্ন অনুমতিক্রমেই কিন্তু ইতিহাস লিখিত হইতেছে। কেবল সম্মান-তালিকার অসমঞ্জসতা নহে। এই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করিবার আহ্বান একের পর এক স্বনামধন্য ব্যক্তি যে ভাবে প্রত্যাখ্যান করিতেছেন, তাহাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসেই খোদিত হইল। আমন্ত্রিতদের যে কোনও এক জনের নাম সমাবর্তনের সহিত যুক্ত হইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব বাড়িত। তিন জনেই ফিরাইয়া দেওয়ায় অগৌরব পুঞ্জীভূত হইল। কেন এই উপর্যুপরি অস্বীকার, জানা নাই। তবে, সমাপতনেরও একটি ছন্দ আছে, এই অনুমান সহজেই চলিতে পারে। এবং সেই অনুমান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গভীর ভাবে অস্বস্তিজনক নিশ্চয়ই। তৎসহ, প্রহসনময়ও।