তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬-এ ধারাটির রচয়িতার নাম যদি হইত জোসেফ স্তালিন বা কিম জং-আন, তবে বিস্ময়ের কারণ থাকিত না। কিন্তু, মস্কো বা পিয়ংইয়াং নহে, আইনটির জন্মস্থান নয়াদিল্লি। ভারতীয় গণতন্ত্রের সদর দফতরে আইনটি প্রসূত হইয়াছিল। বিনা বাধায়, বিনা প্রতিরোধে। গত ছয় বৎসরে আইনটি ভারতীয় গণতন্ত্রের কী ক্ষতি করিয়াছে, তাহা পরের প্রশ্ন। প্রথমে ভাবিয়া দেখিবার, ভারতে গণতন্ত্রের শীর্ষতম কেন্দ্র হইতে কী ভাবে এমন একটি দমনমূলক আইন জন্মাইতে পারে? সুপ্রিম কোর্ট আইনটিকে নাকচ করিয়া জানাইয়াছে, আইনটি স্বচ্ছ তো নহেই, তাহার ব্যাপ্তি বিপুল ও পরিণাম ভয়ঙ্কর। যাঁহারা ভারতীয় গণতন্ত্রের নির্বাচিত এবং মনোনীত চৌকিদার, তাঁহারা আইন পাশ করিবার সময় কথাগুলি এক বারও ভাবিয়া দেখিলেন না? সময় ছিল না বুঝি? যে দ্রুততায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ধারাটি যুক্ত হইয়াছিল, তাহাতে অনুমান করা সম্ভব, মুম্বই হামলা-পরবর্তী জনরোষ হইতে নিজেদের বাঁচাইতেই তাঁহারা ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। গণতন্ত্রের কথা ভাবিবার অবকাশ হয় নাই। পরেও যে খুব ভাবিয়া দেখিয়াছেন, তাহা নহে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিলে অবশ্য অন্য কথা। পশ্চিমবঙ্গে যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আইনের ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত হওয়ার পর বামপন্থীদের বোধ হইয়াছিল, ২০০৮ সালে ঘাড় নাড়িয়া দেওয়া বিচক্ষণের কাজ হয় নাই। কিন্তু, সেই বোধোদয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা, গণতন্ত্রের প্রতি অচলা ভক্তির নমুনা নহে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়টি প্রকৃত অর্থেই ঐতিহাসিক। কিন্তু, ৬৬-এ ধারা ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি অনপনেয় কালো দাগ হিসাবেই থাকিয়া যাইবে। ইন্দিরা গাঁধীর জারি করা জরুরি অবস্থার মতোই। বস্তুত, এক অর্থে এই দাগটি গভীরতর। জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্তটিতে অন্তত বিরোধীদের সমর্থন ছিল না। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৬৬-এ ধারাটি শাসক ও বিরোধী, উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমেই যোগ হইয়াছিল। কেন, তাহা বোঝা কঠিন নহে। যে রাজনীতিক তাঁহার বিরোধী অবতারে এই আইনের বিরোধিতায় নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টের ছবি কালো করিয়া দিয়াছিলেন, তিনিও ৭ রেসকোর্সের বাসিন্দা হইবার পর এই ধারা বিলোপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন নাই। ২০০৮ সালে যাঁহারা এই ধারা আইনে জুড়িয়াছিলেন, আর ২০১৪ সালে যাঁহারা ক্ষমতাসীন হইলেন, প্রকৃতপ্রস্তাবে তাঁহারা সকলেই শাসক। ক্ষমতায় থাকুন আর না-ই থাকুন, তাঁহাদের মানসিকতাটি শাসকের। শাসকের রঙ হয় না। যে কোনও বিরুদ্ধ স্বর তাঁহাদের কানে বিপজ্জনক ঠেকে। অতএব, শাসকরা এক জোট হইয়া গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। এই পাপ মুছিবার নহে।
৬৬-এ ধারাটি যে অত্যন্ত কঠোর ছিল, তাহা নহে। কোনও ‘বেয়াড়া’ নাগরিককে শায়েস্তা করিবার সরেসতর অস্ত্র রাষ্ট্রের তূণে বিলক্ষণ মজুত ছিল। এখনও আছে। এই ধারাটির মহিমা তাহার ব্যাপ্তিতে। ইহার মাধ্যমে কার্যত যে কোনও নাগরিককে হয়রান করিবার অধিকার রাষ্ট্রের আয়ত্ত হইয়াছিল। তাহার জন্য সেই নাগরিকের বিপ্লবী হওয়ার প্রয়োজন পড়িত না। অম্বিকেশ মহাপাত্র হইতে শাহিন ঢাডা বা রেণু শ্রীনিবাসন, কেহই প্রথাগত অর্থে রাষ্ট্রের প্রতিস্পর্ধী হইতে চাহেন নাই। তাঁহারা নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছিলেন মাত্র। সেইটুকুও যাহাতে সম্ভব না হয়, তাহা নিশ্চিত করিবার আয়ুধ ছিল এই ৬৬-এ ধারা। সুপ্রিম কোর্ট নাগরিকের স্বাধীন মতপ্রকাশের সেই অধিকারটুকু পুনর্প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। কিন্তু ভাবিয়া দেখার, যথেষ্ট হইল কি? তথ্যপ্রযুক্তি ৬৯-এ বা ৭৯ ধারা বজায় রাখিবার যাথার্থ্যও বিবেচনা করা প্রয়োজন। নাগরিকের অধিকার, নাকি রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর পিঠ, কোনটি রক্ষা করা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অস্তিত্বের মূল কারণ হওয়া বিধেয়, এই প্রশ্নটি বকেয়া থাকিয়া গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy