Advertisement
E-Paper

অনর্থ(ক)

ছোট্ট ঘটনা মাত্র। তবে বিন্দুই সিন্ধুর দ্যোতক। রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী গত সপ্তাহে যখন বলিলেন, ছাত্রছাত্রীরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক ভাবে অংশগ্রহণ না করিলে তাহাদের শংসাপত্রটি বিশেষরূপে দাগাইয়া দেওয়া হইবে, সহস্র কারণে উদ্বিগ্ন রাজ্যবাসী আবার নূতন উদ্বেগে পড়িলেন। বিপন্নও বোধ করিলেন।

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১

ছোট্ট ঘটনা মাত্র। তবে বিন্দুই সিন্ধুর দ্যোতক। রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী গত সপ্তাহে যখন বলিলেন, ছাত্রছাত্রীরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক ভাবে অংশগ্রহণ না করিলে তাহাদের শংসাপত্রটি বিশেষরূপে দাগাইয়া দেওয়া হইবে, সহস্র কারণে উদ্বিগ্ন রাজ্যবাসী আবার নূতন উদ্বেগে পড়িলেন। বিপন্নও বোধ করিলেন। ভারতীয় সংবিধান কেন রাজ্যপাল পদটি তৈরি করিয়াছে, তাহা জানিয়াই রাজ্যপালগণ নির্ধারিত রাজ্যে পদার্পণ করেন। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের আলঙ্কারিক প্রতীক তাঁহারা, রাজ্য প্রশাসনের কোনও বিষয়েই প্রত্যক্ষ অংশ লইবার ক্ষমতা তাঁহাদের নাই। রাজ্যপাল পদের সুবাদে যখন কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে নিরূপিত হন, তখনও পরিস্থিতি একই: বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তিনি অলঙ্কার-মাত্র, একাধারে বিবেক ও গরিমার অলঙ্কার। এত কিছু জানিয়াও পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপালরা বার বার সীমা লঙ্ঘন করিয়াছেন, রাজনীতির রং নিজেদের গায়ে লাগাইয়া ফেলিয়াছেন। ফল মোটেও ভাল হয় নাই। বর্তমান রাজ্যপালও এ বার, প্রথম বার, সেই অতিসক্রিয়তার পথে পা বাড়াইলেন। পরে অবশ্য তাঁহার বক্তব্য, ও কথা নেহাতই পরামর্শ বা প্রস্তাব ছিল। হয়তো ভাবিয়াছিলেন, সমাবর্তন লইয়া এত গোলযোগ যখন, ছাত্রছাত্রীদের কড়া ধমক দিয়া একটি নৈতিক দায় পালন করা দরকার। কিন্তু তাঁহার নৈতিক ধমকও গভীর অস্বস্তি জাগাইল, ধমকটি এতই অভূতপূর্ব এবং অস্বাভাবিক।

নৈতিক ভূমিকার পথটি কিন্তু খোলাই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসাবে উপাচার্য ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব মিটানোর চেষ্টা। শংসাপত্রে দাগ দিয়া ছাত্রছাত্রীদের ‘শাস্তি’দান সেই পথ নয়। বেত্রাঘাতের শাসনে যদি তিনি বিশ্বাস করেন, সেই জ্যেষ্ঠতাতসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি নিতান্ত ঊনবিংশ শতকীয়! রাজ্যের সারস্বত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে অলঙ্কাররূপেও যদি এমন ঊনবিংশ শতক বিরাজ করে, তবে সমূহ বিপদ। আর, সমস্যা তো কেবল সমাবর্তন অনুষ্ঠানটি লইয়াই নয়। যে সংকটের সূত্রে সমাবর্তন-বিতর্ক, বিভিন্ন পক্ষের সহিত কথা বলা ব্যতীত সেই সংকটের মীমাংসার কোনও গাঠনিক প্রয়াস এখনও অবধি আচার্যকে লইতে দেখা গিয়াছে কি? মীমাংসার প্রয়াস না করিয়াই শাসনের প্রয়াস? নৈতিক ভূমিকার অন্বেষণটি বোধহয় তেমন সুবিবেচিত নয়। হয়তো সুববিচেনার পথটি রোধ করিয়া আছে রাজনীতির হিসাবনিকাশ। অথচ প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন, বর্তমান রাজ্যপালও নিশ্চয়ই তাহাতে বিশ্বাস রাখেন: শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি চলিবে না।

সংকটের মীমাংসাটি লইয়া কিঞ্চিদধিক ভাবিলে আর একটি বিষয়ও জলবৎ স্পষ্ট হইত: সমাবর্তনের মতো একটি নিতান্ত বিধিবদ্ধ অনুষ্ঠান বিষয়ে এত বাড়াবাড়ি সম্পূর্ণ অর্থহীন। সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও যেমন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়েরও সমাবর্তন আছে, এইটুকুই। তাহা লইয়া রাজ্যপালকে মাথা ঘামাইতে হইবে কেন? প্রতি বৎসর নিয়ম করিয়া যেমন নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ঘটে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের গুরুত্ব ঠিক ততটুকুই। সমাবর্তনে কে আসিবেন, কী পরিবেন, কী ‘সম্মান’ লইবেন, তাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আধিকারিকরা স্থির করুন। তাঁহারা ভাবুন, কোন শিল্পপতি কিংবা রাজনীতিক কিংবা ক্রীড়া-তারকাকে তাঁহাদের মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সর্বোচ্চ’ সম্মানে ভূষিত করিতে চাহেন। তাঁহারা বিচার করুন, এ হেন প্রাপকের তালিকা বানাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সারস্বত মান তাঁহারা কী ভাবে ও কতখানি বাড়াইতেছেন বা কমাইতেছেন। ইতিহাস তাঁহাদের এই সকল ভাবনার বিচার করিবে। রাজ্যপালের সেই পরীক্ষায় নামিবার প্রয়োজন কী!

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy