ভারতে প্রধান রাজনৈতিক দল হইতে গেলে কেবল রাজনীতি করিলেই চলে না, ইতিহাসের কূটনীতিটিও করিতে হয়। ইতিহাসের পাল্টা ইতিহাস, কিংবদন্তির পাল্টা কিংবদন্তি, প্রতীকের পাল্টা প্রতীক: এই সরল কথাটি বুঝিতে হয়। সম্ভবত এই বৎসর হইতে ৩১ অক্টোবর দিনটি সেই কূটনীতির রণাঙ্গনে একটি গুরুতর তারিখ হইয়া উঠিল। কেননা, ঘটনাচক্রে দিনটি ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুদিন, এবং একই সঙ্গে সর্দার বল্লভভাই পটেল-এর জন্মদিন। প্রথম কারণে দিনটি কংগ্রেস-অধ্যুষিত ভারতীয় ইতিহাসে মহা-তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু এই বৎসর হইতে যেহেতু কংগ্রেসকে ধুইয়া-মুছিয়া নূতন ভাবে দেশ গড়িবার প্রস্তাবনা করিতেছে ক্ষমতায় আগত বিজেপি, এবং তদুদ্দেশ্যে প্রচলিত ইতিহাসের পাল্টা ইতিহাস গ্রন্থনা শুরু করিয়াছে, দ্বিতীয় কারণটি প্রথমকে প্রবল ভাবে ছাপাইয়া কান ফাটাইয়া দিবার জোগাড়। ৩১ অক্টোবর বল্লভভাই পটেলের সত্যকারের জন্মদিন নয়, জন্মতারিখ না জানা থাকায় তাঁহার স্বনির্বাচিত একটি তারিখ-মাত্র। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিকট এই সবই এহ বাহ্য। মোদী তো সত্যকারের ইতিহাস চাহেন না, তিনি চাহেন ইতিহাসের রাজনীতি। চাহেন, যে ইতিহাস নেহরু-গাঁধী পরিবারকে মহাকায় করিয়া তুলিয়া দেশগগন পরিব্যাপ্ত করিয়া রাখিয়াছে, পরিমার্জনা ও প্রতিযোজনার মাধ্যমে সেই ‘পরিবার’-ইতিহাসের পাল্টা বা বিকল্প প্রতিষ্ঠা করিতে।
নেহরু-গাঁধী পরিবারের এই আশ্চর্য ঐতিহাসিক অতিকায়তা অবশ্যই ইন্দিরা গাঁধীর অবদান, এবং তদর্থে, স্পষ্টত একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। জওহরলাল নেহরুর ধীমান রাজনীতি হইতে সরিয়া আসিয়াও নেহরু-ঐতিহ্যের কেতন ধরিয়া রাখিবার জন্য সে দিন কথায় কথায় পরিবারের এই মহিমা-মণ্ডনের প্রয়োজন হইয়াছিল। অবস্থা এমনই দাঁড়াইয়াছিল যে, এমনকী গ্রামীণ সঞ্চয় প্রকল্পের নাম, কিংবা গ্রামে এলপিজি গ্যাস বণ্টনের প্রকল্পও ইন্দিরা ও রাজীব গাঁধীর নামে ভূষিত হইতে হইল, যাহাতে নিত্যব্যবহারের আওতায় নামগুলি রাত্রিদিন আবর্তিত হইতে পারে! ভারতের স্বাধীনতা-গাথায় গাঁধীজির পরই যে তাঁহার মানস-পুত্র জওহরলাল নেহরুর স্থান, আর কাহারও নহে, ও স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের বাস্তব যে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গাঁধী ও রাজীব গাঁধীরই নির্মাণ, সুতরাং ভারতের সমাজে ও রাজনীতিতে যে সকলের ঊর্ধ্বে এই একটি পরিবারই সত্য: চার দশক যাবৎ এই মহাকাহিনি অবিশ্রান্ত কীর্তিত হইল। পাশাপাশি আরও যে সকল নেতার দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও দূরদৃষ্টি স্বাধীনতা আনিতে সাহায্য করিয়াছিল, তাঁহারা বিস্মৃত হইলেন।
‘মিথ’ বা অতিকাহিনি অনেক ক্ষেত্রেই চিরজীবী নহে, নূতন কাহিনি অতিকায়িত হইয়া পুরাতনকে গ্রাস করিয়া ফেলে। নরেন্দ্র মোদী নানা ক্ষেত্রেই ক্রিয়ার বদলে প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বাস রাখেন। সর্দার পটেলের ভজন-কীর্তনকে তিনি নিশ্চয়ই নেহরু-গাঁধীতন্ত্রের সমপরিমাণ প্রতিক্রিয়ায় পরিণত করিতে চাহিতেছেন। বাড়াবাড়ি দিয়া বাড়াবাড়ির উত্তর দিতে বসিয়াছেন। যে দুই প্রতীকায়িত নেতৃ-ব্যক্তিত্বকে আপাতত যুযুধান রূপে নামানো হইতেছে, তাঁহারা কিন্তু পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন। গাঁধীজি যখন নেহরুকে উত্তরাধিকারী হিসাবে সামনে আনিলেন, উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ অলংকরণ করিয়া পটেল কিন্তু মুহূর্তেকও গাঁধীর উপর ক্ষুব্ধ হন নাই। নেহরুর সঙ্গে তিনি হাত মিলাইয়া কাজ করিয়াছেন, একযোগে সিদ্ধান্ত লইয়াছেন, দায়দায়িত্ব ভাগ করিয়া লইয়াছেন। যখন নেহরুর সঙ্গে দ্বিমত হইয়াছেন, তখনও বয়ঃকনিষ্ঠ জওহরলালের নেতৃত্বে কোনও সংশয় রাখেন নাই, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়া তো দূরস্থান। দুর্ভাগ্য, ‘মিথ’ বা অতিকাহিনি-র ইহাও একটি চরিত্র যে তাহা দ্রুত সত্য ইতিহাসকে ভুলাইয়া মিথ্যা ইতিকথার রচনা শুরু করে।