Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

অসাম্য নিয়তি নয়, ব্যর্থতার পরিণাম

স্বাস্থ্যকে বাজারের হাতে না ছেড়ে রাজনৈতিক উদ্যোগে পরিণত করতে পারলে এবং লোকদের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে যথাযথ মূল্য দিলে অবস্থাটা উন্নততর হয়ে উঠতে পারে। যেমনটা হয়েছে অনেক দেশেই।অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু তাঁর ‘দি ইনভিসিবল হ্যান্ডস’ বই-এর গোড়াতেই একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন: ‘গড়পড়তা হিসেবে আমরা আমাদের পূর্বজদের চেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান নই, এমন দাবি করাটা আসলে কুটিল মনের পরিচায়ক।’

পিয়া সেন ও কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু তাঁর ‘দি ইনভিসিবল হ্যান্ডস’ বই-এর গোড়াতেই একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন: ‘গড়পড়তা হিসেবে আমরা আমাদের পূর্বজদের চেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান নই, এমন দাবি করাটা আসলে কুটিল মনের পরিচায়ক।’ কিন্তু গড়পড়তা আলোচনায় উল্টোটাই দাবি করা হয়ে থাকে: আগে নাকি মানুষ অনেক ভাল থাকত, বহু দিন বাঁচত এবং সুস্বাস্থ্যে উজ্জ্বল থাকত! আমাদের দেশে তো ‘বৈদিক স্বর্ণযুগ’-এর এমন একটা সর্বসুখান্বিত কল্পনা আছে, যেখানে নাকি অভাব বা দুঃখ বলে কিছু ছিল না। প্রাচীন যুগ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সুকুমারী ভট্টাচার্য যতই কেননা তাঁর নিমগ্ন পাঠ-ভিত্তিক বিশ্লেষণে সেই যুগের স্বর্ণাভ কল্পনাকে নস্যাৎ করুন না কেন, আমাদের সংস্কৃত না-জানা ‘বিশেষজ্ঞরা’ সে-সব মানতে নারাজ। বেদে স্বাস্থ্য ও খাদ্য-বিষয়ক আকুল আবেদনগুলো পাঠ না করেই, মানব অস্তিত্ব বিষয়ক সন্দেহগুলো না জেনেই তাঁরা অলীক কল্পনা প্রচার করেন।

এমন নয় যে, আমাদের কোনও সমস্যা নেই: এক গবেষক হিসেব কষে দেখিয়েছেন, প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তী একশো বছরে কেবল অনাহারে বিনষ্ট হয়েছে কয়েক কোটি মানুষ; রোগে-অসুখে মারা গেছে বহু লোক; প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উজাড় হয়েছে বিপুল জনসংখ্যা; এবং এ সবের চেয়ে অনেক বেশি লোকক্ষয় হয়েছে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিধ্বংসী যুদ্ধে। মানুষ সম্মুখীন হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের। কিন্তু, তা সত্ত্বেও তথ্যের আলোয় স্পষ্ট যে, মানুষের কল্যাণব্রতী অগ্রগতি অব্যাহত। জীবনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে, দেহ উত্তরোত্তর সুস্থ-সবল হচ্ছে, মানুষ অধিকতর জ্ঞানবান হচ্ছে।

অর্থনীতি ও মানব উন্নয়ন বিষয়ক তন্নিষ্ঠ গবেষক ও নিরাসক্ত সংখ্যাগণিতের অনুশীলক বলে খ্যাত অ্যাঙ্গাস ডিটন-এর ‘দ্য গ্রেট এসকেপ: হেল্থ, ওয়েল্থ অ্যান্ড দি ওরিজিন অব ইনইকোয়ালিটি’ (প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস), এই আশাব্যঞ্জনায় একটি অসামান্য সংযোজন। সংখ্যাগত তথ্যপ্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে ডিটন-এর আলোচনাটি উঠে এসেছে এক ভিন্নতর, মরমি মনের বাক্চর্চার রূপে। এ মনন বোধ হয় তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, এক শ্রমজীবী উত্তরাধিকার। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের ইংল্যান্ডের খেতমজুর, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য ও নানাবিধ বঞ্চনায় ঘেরা জীবন। অ্যাঙ্গাসের বাবাও পড়াশুনোর প্রবল ইচ্ছা দমন করতে বাধ্য হন। তাঁকে যোগ দিতে হয় সেনাবাহিনীতে, পরে অবশ্য নিজের অদম্য চেষ্টায় কিছু সাফল্য অর্জন। শিক্ষাগত বঞ্চনার অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রেরণা দেয় অ্যাঙ্গাসকে ভাল স্কুলে ভর্তি করার। একই রকম ছবি আমরা এখন প্রত্যক্ষ করি আমাদের দেশে, বঞ্চিত মা-বাবাদের নিজের পেট কেটে ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার প্রবল আকাঙ্ক্ষায়।

অ্যাঙ্গাস আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁর সন্তানরা নানাবিধ স্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারী, সুযোগে সমৃদ্ধ। প্রজন্মক্রমে দারিদ্র, অসাম্য ও নানাবিধ অসুস্থতার মধ্য দিয়ে ডিটন পরিবারের আজ যে উত্তরণ, তা কেবল পূর্বজ ডিটনদের অদম্য আকাঙ্ক্ষার ফল নয়, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে ব্যক্তির প্রয়াস সর্বাঙ্গীণ সহায়তা পেয়ে এসেছে রাষ্ট্রীয় নীতির, যে নীতিতে মানুষের জীবনকুশলতা বৃদ্ধির জন্য বিরাট জোর দেওয়া হয়েছে ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত অর্জনের উপর।

অসাম্য কেবল আয়গত পার্থক্য থেকেই গড়ে ওঠে না, এর সঙ্গে একটা বড় সংযোগ আছে স্বাস্থ্যের সুযোগ সংক্রান্ত বঞ্চনা ও বৈষম্যের। বস্তুত, স্বাস্থ্যগত অসাম্য থেকে, প্রায়শই বিরাট পার্থক্য ঘটে যায় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যেকার উপার্জন ও সম্পদের। জীবনযাত্রার মান উন্নততর হয়েছে, কিন্তু সুবিধাভোগী ও সুযোগবঞ্চিতদের বিভাজন ক্রমবর্ধমান। ডিটন দেখাচ্ছেন, স্বাস্থ্যগত সুযোগসুবিধা ও অর্জনে বহু দেশের উন্নতি যত স্পষ্ট, ততোধিক প্রকট বহু দেশে, বিশেষত আফ্রিকায় পশ্চাৎপদতার মূর্তি। সেখানে পাঁচ বছর বয়সে পৌঁছতে না পৌঁছতেই বহু শিশুর জীবনাবসান ঘটে। পৃথিবীতে জীবনের গড় দৈর্ঘ্য হয়তো বাড়ল, কিন্তু বহু দেশে শিশুমৃত্যুর এই অতিকায় বীভৎসতা প্রতিরোধ না করে স্বাস্থ্যগত অর্জনটাকে সন্তোষজনক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, সম্ভব নয় আয় ও সম্পদের সর্বজনীন উন্নতিও।

দুর্ভাগ্যের কথা হল, শিশুমৃত্যু রোধের সফল উদাহরণগুলো থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে না। কেবল পশ্চাৎপদ দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ নীতি-বৈকল্যই নয়, উন্নত বিশ্বের স্বার্থপরতার দিকটাও এখানে একটা প্রধান সমস্যা। স্বাস্থ্যনীতি বিষয়ে ডিটনের সমালোচনা হল, এই নীতিতে সামূহিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগের অত্যাবশ্যক ভূমিকাকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে গোটা ব্যাপারটাকে খোলা বাজারের বদান্যতার উপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘সন্দেহ নেই, পৃথিবীতে পুষ্টিগত উন্নতি ঘটেছে এবং লোকেরা আগের তুলনায় দীর্ঘদেহী, শক্তিমান এবং স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছে। কিন্তু (যে সব দেশে) শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ করা গেছে, সেগুলিতে কেবল খাদ্যের ব্যবস্থা করেই এটা সম্ভব হয়েছে— এমনটা বললে পুরো ছবিটা ধরা পড়ে না। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রত্যক্ষ রোগ নিয়ন্ত্রণের ভূমিকাটাকে খাটো করে দেখানো হয়। রোগ নিয়ন্ত্রণে বাজার অর্থনীতির সম্পূর্ণ স্বাধীন ও অনপেক্ষ একটা ভূমিকার উপর প্রচণ্ড জোর দেওয়া হয় এবং এতে সামূহিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগের ভূমিকাটাকে প্রায় বিসর্জন দেওয়া হয়।’

কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন ও রূপায়ণের ব্যাপারটা কি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-নিরপেক্ষ? একেবারেই তা নয়। আফ্রিকাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ: বিশ্ব অগ্রসরমান, কিন্তু আফ্রিকার কাছে যেন সেই গতিটার হদিশটুকুও নেই। এর জন্য আফ্রিকার দেশগুলোর রাষ্ট্রনীতি যেমন দায়ী, তেমনই দায়ী তথাকথিত উন্নত দুনিয়া, যারা ‘দাতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ। দাক্ষিণ্যের বোঝা দরিদ্র দেশগুলোকে নিজস্ব সক্ষমতা গড়ে তোলা থেকে বঞ্চিত করছে, তারা কার্যত ‘দাতা’দের দ্বারা লুণ্ঠিত হচ্ছে।

আমাদের ক্রমাগত বোঝানো হচ্ছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনও ভুমিকার দরকার নেই। যদিও নানা দেশে স্বাস্থ্য বিষয়ক পদক্ষেপগুলোর অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে যে, স্বাস্থ্যোন্নতিতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপই মুখ্য উপাদান। কিন্তু, আমাদের দেশে যে ‘বৈদিক স্বর্ণযুগ’ কল্পিত, সেখানে তো রাষ্ট্র ছিল না! ফলে অজ্ঞান ‘বৈদিকতা’ ও অনিয়ন্ত্রিত বাজার-সাফল্যে স্বাস্থ্য হয়ে উঠছে একান্ত ব্যক্তিগত, তার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংযোগ অস্বীকৃত হতে হতে লুপ্তপ্রায়। ‘ভারতীয়ত্ব’ এখানে বিশ্ব বাজারের সঙ্গে খাপে খাপে মেলানো।

তা হলে কি মেঠো আলোচনাটাই ঠিক? পৃথিবী পশ্চাতে প্রস্থান করছে? একেবারেই না। দুনিয়াতে যুদ্ধ, হানাহানি, বঞ্চনা, অসাম্য ইত্যাদি বেড়েই চলেছে, তার মাঝেই আবার বেড়ে চলেছে মানুষের জীবনকুশলতাও। ভারতের মতো নীতি-স্থবির দেশেও লোক-আকাঙ্ক্ষাগুলো বর্ধমান। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সূচকে বেশ কিছু উন্নতি হয়েছে। ডিটনের বিশ্লেষণ থেকে দেখলে, স্বাস্থ্যকে বাজারের হাতে না ছেড়ে রাজনৈতিক উদ্যোগে পরিণত করতে পারলে এবং লোকদের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে যথাযথ মূল্য দিলে অবস্থাটা উন্নততর হয়ে উঠতে পারত। যেমনটা ঘটেছে চিন বা কিউবায়, ইউরোপ বা জাপানে।

এমনটা হয়নি বলে নৈরাশ্যের স্বাচ্ছন্দ্যে ডুব দিয়ে বসে থাকারও মানে নেই। নৈরাশ্য অসাম্যের হাতকেই শক্ত করে। স্বাস্থ্য ও অসাম্যের সম্পর্কটাকে ওয়াকিবহাল আলোচনায় তুলে আনা এবং ধৈর্যের সঙ্গেই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার প্রচেষ্টায় স্থিত থাকা দরকার। স্বাস্থ্য পরিচর্যার যে কুৎসিত রূপ ভারত-সহ পৃথিবীর যে-সব দেশে মানব সক্ষমতার বিকাশকে অবদমিত করে রেখেছে, সেই দশাটাকে অপরাজেয় নিয়তি হিসেবে নয়, দেখা দরকার একটা সমস্যা হিসেবেই। ডিটন দেখাচ্ছেন: ‘অনেক খারাপ জিনিস ঘটে, কিন্তু নতুন নতুন পথেরও জন্ম হয়। আবার পুরনো অসাম্যগুলোর মতোই নতুন নতুন অসাম্যেরও উদ্ভব ঘটে।’

সাফল্য ও ব্যর্থতার এই দ্বন্দ্বে ইতিহাস দেখায়, মানব সমাজের এক প্রজন্ম অন্য প্রজন্মের চেয়ে সুন্দরতর জীবনে উত্তীর্ণ হচ্ছে। ডিটন পরিবারের উত্তরণের কাহিনি দিয়ে শুরু হওয়া একটা বই শেষ হয় দুনিয়া-জোড়া মানুষের সাফল্য-ব্যর্থতার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে উত্তরণের জটিল অথচ অমোঘ এক অনুধাবনের রূপে। মানুষের চিন্তা-চেতনার এই স্বাস্থ্যোন্নতি বিশ্বের এক সামূহিক অনুশীলনেরই ফসল। দৈহিক ও চিন্তাগত স্বাস্থ্যের এই উত্তরণে বৈদিক কল্পস্বর্গ অপেক্ষা বৈশ্বিক বাস্তব বেশি প্রাসঙ্গিক এবং বাজারের চেয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এর সঙ্গে যুক্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pia sen kumar rana
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE