ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি অমিত শাহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সদর দফতরে কামান দাগিয়াছেন। বোফর্স কামান। আশির দশকে রাজীব গাঁধীর বিরোধীরা যে স্লোগানটি বানাইয়াছিলেন, অমিত শাহের প্রেরণায় তাঁহার দলীয় কর্মীরা তাহাতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নামটি বসাইয়া দিয়াছেন। সারদা কেলেঙ্কারিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ক্রমশ জড়াইতেছে। কেবল সুদীপ্ত সেনের সহিত যোগাযোগের অভিযোগ নহে, সত্য গোপনের অভিযোগও উত্তরোত্তর প্রবল হইতেছে। সংশয়ের যথেষ্ট কারণ দেখা দিয়াছে যে, মুখ্যমন্ত্রী সুদীপ্ত সেনকে বিলক্ষণ চিনিতেন, তাঁহাদের পরিচয় ‘দু’চারটি অনুষ্ঠানের মঞ্চে’ দেখা হওয়ায় সীমিত ছিল না। অভিযোগ এবং প্রমাণ নিশ্চয়ই এক নহে, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ‘সততার প্রতীক’ ভাবমূর্তিটি জোর প্রশ্নের মুখে পড়িয়াছে। সত্যই তিনি সজ্ঞানে সত্যগোপন করিয়া থাকিলে রাজ্যবাসীর নিকট তাহা বিশ্বাসঘাতকতা বলিয়াও প্রতিপন্ন হইতে পারে। অমিত শাহ এই ক্রান্তিকালের সদ্ব্যবহার করিয়াছেন। কিন্তু, কলিকাতায় প্রথম রাজনৈতিক সফরেই তিনি যাহা পারিলেন, পশ্চিমবঙ্গের অন্য দুই— অপেক্ষাকৃত প্রতিষ্ঠিত ও জনসমর্থিত— বিরোধী দল তাহা পারিল না কেন?
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনীতিতে কংগ্রেসের বৃহত্তম অবদান খুঁজিতে বসিলে একটি শব্দের দ্বারস্থ হইতে হইবে। ‘তরমুজ’। বামফ্রন্ট আমলের বৃহত্তর অংশে দলের ভূমিকা এই একটি শব্দে ধরা আছে। আর এখন এই রাজ্যে ভারতের প্রাচীনতম দলটির অবস্থা হযবরল-খ্যাত উদোর ন্যায়। স্লেটে আঁক কষিতেছে, সিপিএম-কে চার আনার সমর্থন করিলে বেশি লাভ, না কি উত্তরবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের তিন ইঞ্চি বিরোধিতা করিলে? সারদা কেলেঙ্কারির প্রেক্ষিতে রাজ্য কংগ্রেস কোন অবস্থান লইবে, খড়ি হাতে নিশ্চয় সেই হিসাবও হইতেছে। ফলাফল ত্রৈরাশিকে মিলিবে, না ভগ্নাংশে, রাজ্যবাসীর অবশ্য কৌতূহল নাই। অন্য দিকে আছেন বামপন্থীরা। তাঁহারা গাজায় ইজরায়েলি সন্ত্রাসের তীব্র নিন্দা করিয়া ক্লান্ত, সারদা কেলেঙ্কারিকে বিরোধী রাজনীতির আয়ুধ বানাইবার মতো শক্তি তাঁহাদের আর নাই। ক্ষমতার আঁচ সরিয়া যাওয়ার পর দলটিতে আর বাষ্প নাই, ফলে তাঁহারা স্থবির হইয়াছেন। তাঁহারা সম্ভবত দেখিয়া খেলিতে চাহিতেছেন। সাজানো বাগান কবেই শুকাইয়াছে, দেখিতে দেখিতে শুকানো বাগানও হয়তো বিলীন হইবে। কে বলিতে পারে, এই দুর্নীতির আর্থিক বহর কতখানি, হয়তো নিভৃতে সেই হিসাব চলিতেছে। অঙ্ক কষা হইলে কেলেঙ্কারির বিকল্প বাজেট পেশ করা হইবে। অবশ্য, এ প্রসঙ্গে এ-যাবৎকাল যে বাম নেতারা মুখ খুলিয়াছেন, তাঁহাদের কথা শুনিবার পর মনমোহন সিংহের অমর উক্তিটি পুনরাবৃত্তি করিতে ইচ্ছা করে— হাজার কথা অপেক্ষা নীরবতা শ্রেয়!
দুই ‘প্রতিষ্ঠিত’ বিরোধী দলের নীরবতার প্রেক্ষিতে অমিত শাহের আগ্রাসন স্বভাবতই নজর কাড়িতেছে অনেক বেশি। এই আক্রমণ নির্বাচনে কতখানি প্রভাব ফেলিবে, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। ভারতের বহু রাজ্যে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকরা যে ভাবে জনাদেশ অর্জন করিয়া ক্ষমতায় ফেরেন, তাহাতে ভোটের বাজারে দুর্নীতির মূল্য লইয়া প্রশ্ন উঠিতেই পারে। কিন্তু তাহা ভিন্ন তর্ক। বিরোধী রাজনীতি করিতে হইলে তাহা কী ভাবে করা বিধেয়, আগন্তুক অমিত শাহ বিধান ভবন ও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটকে শিখাইয়া গেলেন। নিক্তি মাপিয়া বিরোধী রাজনীতি হয় না। ছয় মারিবার বল পাইয়া তাহাতে এক রান নিলে তাহা বিবেচনার পরিচায়ক নহে। ছয় মারিবার ক্ষমতাটি রাজ্য কংগ্রেস এবং সিপিএম-কে পাকাপাকি ভাবেই ত্যাগ করিয়াছে কি না, তাহাও অবশ্য বড় প্রশ্ন।