Advertisement
E-Paper

আত্মহত্যার অধিকার

স্বেচ্ছা-মৃত্যুর অধিকার এখনও অর্জিত হয় নাই, তাহা লইয়া বিতর্ক অব্যাহত। কিন্তু আত্মহননের অধিকার সরকারের ছাড়পত্র পাইতে চলিয়াছে। এই মর্মে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারাটি রদ করিতে প্রায় সর্বসম্মতি মিলিয়াছে। যে মানসিক অবসাদ, গ্লানি কিংবা হতাশা মানুষের বাঁচিয়া থাকার উৎসাহ হরণ করিয়া লয়, তাহাই অধিকাংশত মানুষকে আত্মঘাতী করিয়া তোলে।

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১

স্বেচ্ছা-মৃত্যুর অধিকার এখনও অর্জিত হয় নাই, তাহা লইয়া বিতর্ক অব্যাহত। কিন্তু আত্মহননের অধিকার সরকারের ছাড়পত্র পাইতে চলিয়াছে। এই মর্মে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারাটি রদ করিতে প্রায় সর্বসম্মতি মিলিয়াছে। যে মানসিক অবসাদ, গ্লানি কিংবা হতাশা মানুষের বাঁচিয়া থাকার উৎসাহ হরণ করিয়া লয়, তাহাই অধিকাংশত মানুষকে আত্মঘাতী করিয়া তোলে। তাহা করিতে গিয়া ব্যর্থ হইলে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী এত কাল তাঁহাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হইত। যেন আত্মহত্যা করিতে না-পারাটা কিংবা করার চেষ্টা করিয়া অসফল হওয়াটাই অপরাধ, যাহার কঠোর শাস্তি প্রয়োজন। স্পষ্টতই দণ্ডবিধির এই ধারাটির মধ্যে তুঙ্গ অমানবিকতা রহিয়াছে। আত্মহননে ব্যর্থ মানুষের যাহা প্রয়োজন, তাহা হইল সান্ত্বনা, শারীরিক-মানসিক শুশ্রূষা। তাহার পরিবর্তে সমাজ এত কাল আত্মহত্যায় ব্যর্থ ব্যক্তির অবসাদ, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব বৃদ্ধি করার পাশাপাশি উপরন্তু অপরাধীর তকমা দিয়া বিচারের কাঠগড়ায় টানিয়া লইয়া গিয়াছে।

আত্মহত্যার অধিকারের সহিত ব্যক্তির স্বাধিকারের প্রশ্নটিও জড়িত। আমার জীবন লইয়া আমি কী করিব, তাহা ভাবার এবং তদনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ অধিকার আমার থাকা উচিত। এখানে পারিবারিক-সামাজিক স্তরে একটি সূক্ষ্ম সংযোজন বা সংশোধনী প্রাসঙ্গিক। অনেক সময় সম্পত্তি বেহাত করার বাসনায় পরিবারেরই কোনও কোনও সদস্য এক জনকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিতে পারে। প্রায়শ দেখা যায়, ভারতীয় সমাজে ব্যাপক বধূহত্যা ‘আত্মঘাত’ রূপেই শ্বশুরালয় কর্তৃক প্রচারিত হইয়া থাকে, যদিও কেরোসিন ঢালিয়া গায়ে আগুন দিতে নববধূকে প্ররোচিত করার পিছনে দেবর-ননদ-শাশুড়ি-শ্বশুর সহ এমনকী স্বামীরও উস্কানি থাকে। এগুলি যে আত্মহত্যা বলিয়া গণ্য হওয়ার যোগ্য নয়, তাহা স্পষ্ট। বরং আইনের চোখে এই সব আত্মহত্যা খুনেরই নামান্তর। তাহার জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধিতে পৃথক আইন রহিয়াছে, ৩০৯ ধারাকে সে জন্য বহাল রাখার প্রয়োজন নাই। প্রয়োজন যে নাই, তাহা অনেক আগেই দেশের আইনপ্রণেতারা উপলব্ধিও করিয়াছিলেন। বস্তুত, প্রায় ৪৪ বছর আগে আইন কমিশন এই আইন রদ করার সুপারিশ করিয়াছিল। কিন্তু এ দেশ দীর্ঘসূত্রিতার জন্য খ্যাত, কোনও কিছুই এখানে সময়মতো হয় না। তাই ক্রমাগত এই সংক্রান্ত পদক্ষেপ বিলম্বিত হইতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা যেহেতু রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত, তাই বিধি সংশোধনে রাজ্যগুলির বক্তব্য জানার প্রশ্নও উঠিয়া পড়ে। শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ রাজ্য ইহাতে সম্মত হওয়ায় এখন আর আইনটি রদ করিতে কোনও বাধা নাই।

এই আইন রদ হইলে মণিপুরে ১৪ বছর ধরিয়া অনশনরতা ইরম শর্মিলা চানুও মুক্তি পাইবেন। অনশন করিয়া তিনি আত্মঘাতী হইতে চাহেন, এই অভিযোগেই ৩০৯ ধারায় তাঁহাকে এত কাল গ্রেফতার করিয়া রাখা হইয়াছে। কেননা গ্রেফতার না করিলে তাঁহাকে জোর করিয়া খাওয়ানো সম্ভব হইত না। আর সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনশনরত বিক্ষোভকারীর মৃত্যু রাষ্ট্র ও সরকারকে চরম অস্বস্তিতে ফেলিয়া দিত। রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে ‘আমরণ অনশন’কে মহাত্মা গাঁধী হইতে শুরু করিয়া অনেকেই ব্যবহার করিয়াছেন, ভবিষ্যতেও করিবেন। তখন অনশনকারীকে বাঁচাইতে রাষ্ট্র অন্য আইনের শরণ লইতে পারে, কিন্তু অনশন করাকে অপরাধ বলিয়া গণ্য করিতে পারিবে না। একই ভাবে জীবন সম্পর্কে বীতস্পৃহ, চরম হতাশায় ভুগিতে থাকা নিঃসঙ্গ ব্যক্তি-মানুষের আত্মহননকে আর কোনও সামাজিক বা আইনি অপরাধ বলিয়া শনাক্ত করা যাইবে না। এই শনাক্তকরণের মধ্যে যে রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতা আছে, তাহার অবসান রাষ্ট্রকেই আরও মানবিক করিবে।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy