Advertisement
E-Paper

আর কাশ্মীর?

বিশাল ভরদ্বাজ কি তৈরি করতে পারলেন একটা কাশ্মীর, যা ব্যক্তি-শোক প্রতিশোধের থেকেও বড়? ‘হায়দার’ দেখার পরে এ প্রশ্ন থেকেই যায়।ডাক্তার বাবার তরুণ সন্তান হায়দার আলিগড় ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে দেখে, আহত জঙ্গির চিকিত্‌সা করতে গিয়ে দেশদ্রোহিতার অপরাধে আর্মির হাজতে চালান হয়ে আব্বা নিখোঁজ, আর্মিরা তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আর তার মা, স্বামীর পাকা মৃত্যুসংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত আধা-বিধবা, শ্বশুরবাড়ির কানাচে মিহি পর্দার আড়ে দেওরের সঙ্গে হাসি-মজাক রত।

ঈপ্সিতা হালদার

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০

ডাক্তার বাবার তরুণ সন্তান হায়দার আলিগড় ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে দেখে, আহত জঙ্গির চিকিত্‌সা করতে গিয়ে দেশদ্রোহিতার অপরাধে আর্মির হাজতে চালান হয়ে আব্বা নিখোঁজ, আর্মিরা তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আর তার মা, স্বামীর পাকা মৃত্যুসংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত আধা-বিধবা, শ্বশুরবাড়ির কানাচে মিহি পর্দার আড়ে দেওরের সঙ্গে হাসি-মজাক রত। পরিত্যক্ত হওয়ার বোধ ও বাবার স্মৃতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতায় হায়দার জ্বলে ওঠে। সারা কাশ্মীর ঢুঁড়ে শেষে জানতে পারে তার বাবা মৃত। বাবার সঙ্গে একই হাজতে বন্দি রুহদার তাকে জানায় বাবার একমাত্র খোয়াইশ। যে, যে চোখ তোমার মা’কে কামনা করেছে, তাতে দু’টি বুলেট পুরে দাও। তাই হায়দার জঙ্গিদের ডেরায় গিয়ে হাতে তুলে নেয় রিভলভার। এখানে এই ব্যক্তিক ইন্তেকামের প্লট কাশ্মীরের বৃহত্‌ ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে যায় বিশাল ভরদ্বাজের প্লটে, কারণ আব্বার আর্মির হাতে কোতল হওয়ার পিছনে চাচার রাজনৈতিক হাত রয়েছে, এটা তত দিনে জেনে গেছে হায়দার।

শেক্সপিয়র ট্রিলজির অংশ হিসেবে ‘হায়দার’ কতখানি ‘হ্যামলেট’, সে প্রশ্ন তোলা যায়, কিন্তু আপাতত তোলাই থাকুক। প্রশ্ন এটা, ব্যক্তির টানাপড়েন রিক্ততা রিরংসার খণ্ড ছবি দিয়ে বিশাল ভরদ্বাজ ১৯৯৫-পরবর্তী সময়ে কাশ্মীরে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবিরোধীদের বুঝতে চেয়েছেন? ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’-এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সন্ত্রাস দেখাতে চেয়েছেন? না, ব্যক্তির একনিষ্ঠ ব্যক্তিক গল্প বসাতে চেয়েছেন ওই হানাহানির পরিপ্রেক্ষিতে? যে পিতৃঘাতক, সে-ই মাতার শয্যাকে কলুষিত করেছে; তার প্রতি ঘৃণা ও ক্রোধ, আর বদ্ধ ব্যক্তিগত পারিবারিক রক্তসম্পর্কজাত ঘুলিয়ে ওঠা কামনা ঈর্ষার প্রতিশোধের গল্প কি একটি ভূখণ্ড নিয়ে দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে ভয়াবহ অবিশ্বাস ঘৃণা বিদ্বেষের যে যুদ্ধ প্রকল্প, তাকে তুলে ধরতে পারে? হায়দারের ব্যক্তিগত শোক-ঈর্ষা-প্রতিশোধের কাহিনি পেরিয়ে কাশ্মীরের রাজনৈতিক সংকট বুঝে ওঠা গেল কি? কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ, সন্তান-পিতা-স্বজন হারানো হাজার হাজার পরিবার, আর্মি স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ায় আনজানা ভবিতব্য নিয়ে আধা-বিধবাদের ভিড়, নাশকতা দমনে আলটপকা মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ফলে তরুণশূন্য একটা জনপদ, এ-সব কাশ্মীরের সত্য হিসেবে কতখানি এল, যখন বিশাল ভরদ্বাজ হ্যামলেটকে হিন্দুস্তানি বানালেন? শুরুতে দেখানো হয়েছে বটে হায়দার যখন নিখোঁজ বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, সে দেখতে পাচ্ছে কাশ্মীরের স্বরূপ, যেখানে নিখোঁজ সন্তানের বাপ-মায়েদের তৈরি অ্যাসোসিয়েশন, আধা-বিধবাদের দল তাদের নিখোঁজ অতিপ্রিয়জনের সন্ধানে কী রকম ধরনা দিয়ে রয়েছে, যেন বা তাদের কয়েকটা জীবন পেরিয়ে যাচ্ছে সেই অভিশপ্ত প্রতীক্ষায়। হায়দার তাদের এক জন হয়ে স্লোগান দিচ্ছে, ফেস্টুন তুলে ধরছে। কিন্তু প্রতিবাদ আর প্রতীক্ষা বদলে যাচ্ছে প্রতিশোধে, যখন সে জানতে পারছে আব্বা মৃত আর চাচা-ই বকলমে পিতৃহত্যাকারী, যে তার মা’কে কামনা করে।

প্রশ্ন উঠবে, এই যে হায়দারের মা গাজালা, যিনি হাজার হাজার আধা-বিধবাদের এক জন, তাঁর দেওরের সঙ্গে সম্পর্ক নিতে না-পেরে ছেলে পাগলে যাওয়ায় তাঁর যে ব্যক্তিগত সংকট, তাতে কি সত্যি অকিঞ্চিত্‌কর হয়ে গেল না আধা-বিধবা পদধারী মহিলাদের বিপুল ভিড়? যাঁরা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত দায়িত্বহীন সন্ত্রাস দমননীতির ফল? একটা জ্বালিয়ে দেওয়া বাড়ি দেখতে গিয়ে আমরা কোথাও দেখলাম না অন্য জ্বালিয়ে দেওয়া বাড়ি। আর্মি-সন্ত্রাস দেখতে গিয়ে আমরা যুযুধানরত অন্য দলের লড়াই নীতি যুদ্ধবন্দি নীতি সম্পূর্ণ না জেনেই থাকলাম। কাশ্মীর অঞ্চলের বর্তমান ও ভবিষ্যত্‌ যে কালো আলকাতরার মতো ঢেকে যাচ্ছে, তার সম্যক ছবি তো প্রায়ই জায়গা পেল না এই ব্যক্তি আখ্যানে। আধা-বিধবা বা নিখোঁজ পরিজনের পরিসংখ্যান না-হয় না এল, কিন্তু এই আধা-বিধবাদের অনুপস্থিতি বা হায়দারের বাবার মতো অন্য অনেকের উপস্থিতি ছবির শুরুতেই এমনই দ্রুত একটি শটে সেরে দেওয়ায় উপদ্রুত ব্যাপক কাশ্মীরের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয় না কোনও।

হায়দার অবশ্যই জঙ্গিদের কাছ থেকে পায় রিভলভার। যেহেতু তার যৌনঈর্ষা প্রবল আর পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চাচাকে খুন করতে চায়, যে ঘাতক জঙ্গিদেরও লক্ষ্য, তাই তার ব্যক্তি-আখ্যান মিলে যায় কাশ্মীরের রাজনৈতিক আখ্যানের সঙ্গে। না কি এ ভাবে ভাবব যে, কেবল ইতিহাসের তথ্যনিষ্ঠ পুনর্নির্মাণ শিল্পের কাজ নয়? সেটা ডকুমেন্টারি করবে, আর ফিকশান মানব মনের খণ্ড দ্বন্দ্ব ইচ্ছে বাঁচা বা মরার আকুলতা আড়ষ্টতার অন্য মহাফেজখানা তৈরি করবে? যেখানে এটা দেখিয়ে দেওয়া যাবে যে হ্যঁা, এমনকী নিখোঁজ মহান পুরুষের মহীয়সী স্ত্রীও সেই প্রতীক্ষার ভার সহ্য না করতে পারেন। তাঁর দরকার হতে পারে বাইরে কারফিউ চললে বদ্ধ কোণের ঘরে এক কলি গান হাসিতে গুমরে গেয়ে ওঠা, মুগ্ধ নাছোড় পুরুষের সামনে। কারণ, ছেলে তো ছেলেই, এক দিকে মায়ের গলার আতরের গন্ধ নিজে আগলে রাখবে, বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ব্যাগে রিভলভার পুরে সে নিয়ে গাছের কোটরে গান গেয়ে প্রেমিকা চুমু খাবে, আর মা’কে তার কামনা চেপে থাকতে হবে সাবিত্রী। বরং ভাবলাম, অতি দুর্দিনে গাজালা কাউকে প্রেমিক করতে পারে, আবার তারই সামনে দাঁড়াতে পারে সুইসাইড বম্বার হয়ে, লাল শাল ঝটকায় খুলে বেআব্রু দেখাতে পারে সমস্ত বুকে সাজানো গ্রেনেডগুলি। শিল্পই পারে দেখাতে, তিন বুড়ো বরফে স্থির নিথর প্রকৃতির মধ্যে গানের ঝোঁকে বেলচা দিয়ে গোর খুঁড়ছে। তরুণশূন্য কাশ্মীরের বুজুর্গরা নিজ হাতে গোর দিয়েছেন সন্তানের মরদেহগুলি, খুঁড়ে রাখছেন কাশ্মীর-ভবিষ্যতের কবরস্থান।

না কি বলার গল্প এটাই যে, নানা তরুণের নানা দুর্বলতা ক্ষুধা, বঞ্চনার বোধ, দাবি ছিনিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা কাজে লাগায় রাষ্ট্র, আবার রাষ্ট্রবিরোধীরাও। তার মাঝে পড়ে যায় এমনকী আলিগড়ে গবেষণারত তরুণও, যে কবিতা লেখে। এটাও সত্যি যে, উপরের অঙ্গুলি হেলনে চলতে থাকে অন্ধ ব্যবস্থা আপামর। তা হলে কি ‘হায়দার’ সেটাই দেখায়? যে, ব্যক্তি-হায়দারের উন্মত্ত আবেগকে নিজের মতো করে ব্যবহার করল একটা গোষ্ঠী?

পরিবারের কয়েক জন মানুষকে ঘিরে কামনার যে বলয় চলছে, ছবিটি যদি এটাই দেখায়, তা হলে আমরা ধরেই কেন নেব, হায়দারের মাধ্যমে কাশ্মীরকে পাওয়া যাবে ইতিহাসের মতো? এখানে কাশ্মীর প্রেক্ষাপট মাত্র, যেখানে এটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কিন্তু সেই প্রেক্ষাপটের গুরুত্ব ভয়াবহ, যেহেতু তা দর্শককে স্বস্তি দেয়নি এক মিনিটও। ব্যক্তির আখ্যান দিয়ে সমষ্টির কথা বলা যেতে পারে, আবার সেটা উদ্দেশ্য না-ও হতে পারে সর্বদা। যেমন আর্মি অধ্যুষিত মণিপুরেই মেরি কমের বাড়ি না?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক

post editorial ipsita halder
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy